খননের অভাবে বিপন্ন হবিগঞ্জের নদী-খাল
শুকিয়ে যাওয়া খাল পাওকাটা
মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ : মাঘ শেষে ফাল্গুন। আসছে চৈত্র মাস। পৌষেই খাল শুকিয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে শুকাতে থাকে নদী ও বিল। এ অবস্থায় দেশীয় মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বোরো ধানের চাষে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জেলার হাওর এলাকার বিভিন্ন খাল শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। অনেক বিল ও নদীতে একইভাবে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকস্থানে ভরাট হয়ে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে নদী ও বিল। আবার শিল্পবর্জ্য প্রবেশের কারণেও অনেক নদীর বিপন্নদশা।
উদ্বেগের বিষয় পরিকল্পিতভাবে এসব খাল-বিল-নদী খননের উদ্যোগ নেই। কর্তৃপক্ষ এদিকে তেমন কোন নজর দিচ্ছেন না। এমন কী পরিবেশ রক্ষাকারী নানা সংগঠন বিভিন্ন সময়ে দাবি তুললেও কেউ শুনছেন না।
হবিগঞ্জ পাহাড় ও হাওর-বাওরের জেলা । বেশিরভাগ এলাকা জুড়েই নদী-নালা, খাল-বিল। এসব জলাশয় কখনও খনন হয়েছিল কী না, এ তথ্য বর্তমান সময়ের কেউই জানেন না।
জেলা মৎস্য বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় জলাশয়ের পরিমাণ ৯৭,১৩৫. ১৫ হেক্টর। এর মধ্যে ৫৪টি হাওর এলাকায় সরকারি বিলের সংখ্যা ৬৭৫ এবং বেসরকারি বিলের সংখ্যা ৫৩৭। সেইসঙ্গে রয়েছে বরাক, খোয়াই, শুঁটকি, রত্না, সুতাং, ভেড়ামোহনা, বিজনা, কুশিয়ারা, সোনাই, করাঙ্গীসহ অন্যান্য নদনদী। এছাড়া ৭৪টি খালের পাশাপাশি রয়েছে বিপুল সংখ্যক পুকুর, ডোবাসহ নানা জলাশয়।
এক সময় জেলায় বছরে মাছের উৎপাদন ছিল ২৮,৪৭৪ টন। এখানে মাছের চাহিদা ২২,৯০৯ টন। উদ্বৃত্ত থাকত ৫,৫৬৫ টন মাছ। বর্তমানে উৎপাদন বেড়ে ৪৯,০০৫ টন হয়েছে। এরমধ্যে চাহিদা রয়েছে ৪২,০৮৬ টন। উদ্বৃত্ত থাকছে ৬,৯১৯ টন।
সূত্র জানায়, এক সময় জেলার শায়েস্তাগঞ্জ শহরের কাছে ছোট ও বড় বিল নামে দুইটি বিল ছিল। বর্তমানে এ দুইটি বিলের কোন অস্তিত্ব নেই। এখানে মাছের বদলে চাষ হচ্ছে ধান। এমনভাবে জেলার বিভিন্নস্থানে বিলগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হারাচ্ছে ঐতিহ্য। অনেক স্থানে খাল বিল নদী ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, নদী, বিল ও খালের পানিকে কেন্দ্র করে হাওরে নিচু জমিতে এক ফসল ( বোরো ধান) চাষ হয়ে আসছিল। হাওরের পাশাপাশি উজান এলাকায়ও বোরো ধান চাষ হচ্ছে। কিন্তু এসব ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় জশালয়ে প্রাকৃতিক পানির সংকট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে প্রায় চাষিই পাম্পের মাধ্যমে উত্তোলিত পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে বোরো ধান চাষ করছেন। শুধু তাই নয়, জলাশয়ের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় দেশীয় মাছের সংকটও দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলার বাহুবলের লালপুরের বাসিন্দা কৃষক আবুল কালাম(৫০) বলেন, ‘খাল আর নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। নদীর পানি দিয়ে বোরো ধানের রোপন শুরু করেছিলাম। বর্তমানে পুকুর থেকে সেচের মাধ্যমে পানি দিয়ে ধান চাষ করতে হচ্ছে।’
তিনি জানান, এ অবস্থায় জলাশয়গুলো পরিকল্পিতভাবে খনন করা প্রয়োজন। তাহলে, জলাশয়ে পানি জমাট থাকবে। এ পানি দিয়ে বোরো ধানের চাষাবাদ করা সহজ হবে। মাছের বংশও বৃদ্ধি পাবে।
শায়েস্তাগঞ্জের সুতাং এলাকার বাসিন্দা সিতার মিয়া(৫২) বলেন, ‘সুতাং নদীর পানি দিয়ে বোরো ধান চাষ করতাম। বর্তমানে এ নদীর পানি শিল্পবর্জ্যে দূষিত হয়ে যাচ্ছে। আবার নদী ভরাট হওয়ায় পানিও হ্রাস পেয়েছে।’
জেলার বাহুবলের নোয়াই এলাকার বাসিন্দা সুজন মিয়া বলেন, ‘পাওকাটা খাল নদীতে শুকিয়ে গেছে। তাই বোরো ধান চাষে সমস্যা দেখা দিয়েছে। পাও খাটার প্রায় স্থানেই পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। খনন করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল হাওর, নদী, বিল,খাল রক্ষায় জরুরীভিত্তিতে জলাশয় খনন ও শিল্পবর্জ্য বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
হবিগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহ মো. এনামুর রহমান বলেন, ‘বরাদ্দ সাপেক্ষে বিল খনন করা হয়ে থাকে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি জানান, সরকারীভাবে জেলার গহীন জলাশয়ে ৪টি মাছের অভয়াশ্রম রয়েছে। মাছের উৎপাদনকে আরও এগিয়ে নিতে নতুন নতুন অভয়াশ্রম করার পরিকল্পনা রয়েছে।
হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ ফজলুর রহমান বলেন, ‘জেলার১ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। সেচের সু-ব্যবস্থা রয়েছে। তাতে করে চাষিরা সেচের মাধ্যমে বোরো ধানের ভাল ফলন আশা করছেন।’
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস থেকে জানানো হয়, বরাদ্দ এলেই নিয়মনীতি মেনে জলাশয়ে খনন কাজ করা হচ্ছে।
রাইজিংবিডি/হবিগঞ্জ/৫ মার্চ ২০১৭/মামুন চৌধুরী/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন