ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘সাহিত্যে নতুন রক্ত প্রবাহিত হওয়া দরকার’

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘সাহিত্যে নতুন রক্ত প্রবাহিত হওয়া দরকার’

রাইজিংবিডির স্টলে মারুফ রায়হান (ছবি : সাইফ রাজু)

মারুফ রায়হান। কবি, সম্পাদক। দেশের প্রথম অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘বাংলামাটি’-র প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য মাসিক ‘মাটি’। বিগত দেড় দশক ধরে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একুশের সংকলন প্রকাশ করে আসছেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রতি শুরু করেছেন বিশ্বসাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘নিসর্গ ও নক্ষত্র’। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে আসেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাইজিংবিডি ডটকমের স্টলে। এ সময় সাহিত্য, সম্পাদনা, বই, লেখক, পাঠক ও বইমেলা নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ।

সাইফ বরকতুল্লাহ  : বইমেলায় এলেন কেমন দেখলেন?

মারুফ রায়হান : দুটো ভাগ তো। এই পাশে (বাংলা একাডেমি চত্বরে) আজ প্রথম এসেছি। আমার কাছে অনেক প্রাণহীন লাগল। লিটলম্যাগ চত্বরে এখনো জমজমাট আড্ডা দেখলাম না। এখন সান্ধ্য (সন্ধ্যা ৭টা)। তবুও জমেনি লিটল ম্যাগ চত্বর। লেখকদের সঙ্গেও তেমন দেখা হয়নি। তার মানে আমার কাছে মনে হয়েছে, ওই পাশে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) যে আসল মেলা হচ্ছে, ওটাই আসল মেলা। ওখানেই জমজমাট হয়ে উঠেছে।

সাইফ বরকতুল্লাহ  :  এ পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে মেলাটা এক জায়গায় (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) হলে ভালো হতো?

মারুফ রায়হান : সেটা তো অবশ্যই ভালো হবে। তবে এটাও একটা চিন্তা যে এখানে (বাংলা একাডেমি চত্বর) বিভিন্ন মিডিয়া সেন্টার, এনজিও, বিভিন্ন সংস্থার স্টল আছে। তবে লিটলম্যাগ চত্বরটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে গেলে ভালো হতো।

সাইফ বরকতুল্লাহ  : এবার আপনার কী কী বই এসেছে?

মারুফ রায়হান : এবার দুটি বই এসেছে। একটি কবিতার বই ‘হাসছে আরোগ্যসদন’। এটি মিজান পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আরেকটি বই হলো ‘ধ্বনি আর ধ্যানী’। এটি প্রকাশিত হয়েছে চিত্রা প্রকাশনী থেকে।

সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা এলেই বই উৎসব হয়, প্রচুর বই প্রকাশিত হয়। মিডিয়ায় ব্যাপক কাভারেজ পায়। কিন্তু বছরের অন্য মাসগুলোতে তা হয় না। আপনার ভাবনা কী?

মারুফ রায়হান : সারা বছর ধরে উৎসবের সুযোগ হয়তো নেই। তবে বইকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আয়োজন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে হতেই পারে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র যদি উদ্যোগ গ্রহণ করে, বাংলা একাডেমি যদি তার পাশে থাকে তাহলে লেখক-পাঠকদের মেলবন্ধন হতে পারে। অন্তত সারা বছর না হলেও ছয় ঋতুতে ছয়টা উৎসব হতে পারে।

সাইফ বরকতুল্লাহ : কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সারা বছরই বই বের হওয়া উচিত..

মারুফ রায়হান : শুধু বইমেলাকে কেন্দ্র করে নয়, বই সারা বছরই বের হওয়া উচিত। আপনি দেখবেন, বইমেলায় ৩/৪ হাজার বই বের হবে। কিন্তু পাঠককে নোটিশ করতে পারে না বই। সব বইয়ের খবরও পায় না পাঠক। একজন প্রকাশক যদি ১০০টি বই বের করেন তাহলে তিনি সারা বছরই বই বের করতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি বইমেলাতে ১০০টি বই নিয়ে আসেন, তাহলে সব বই বিক্রি করতে পারবেন বলে মনে হয় না। আরেকটি দিক হলো, নতুন বই কোনটি? আমি আপনি যে বইটি পড়িনি এখনো সেটি কিন্তু নতুন বই। তাই বলব সারা বছর ধরে বই বের হতে পারে এবং ভালো বইগুলোকে নির্বাচন করা দরকার। মিডিয়ার একটা দায়িত্ব আছে, সিনিয়র লেখকদের দায়িত্ব আছে- তা হলো গড়ে বইয়ের কাভারেজ না করে বেছে বেছে ভালো বইয়ের কাভারেজ দেওয়া উচিত।

সাইফ বরকতুল্লাহ : ইদানিং একটা অভিযোগ শোনা যায় যে সম্পাদনা ছাড়াই বই বের হচ্ছে, বইয়ের মান কেমন- তবে এর মাঝেই কিন্তু অনেক লেখক বের হয়ে আসছেন। অনেক নবীন লেখক ভালো লিখছেন। এ নিয়ে আপনার ভাবনা?

মারুফ রায়হান : নতুন লেখক অবশ্যই প্রতি বছর আসছে। মানে নতুন বই নিয়ে একদম অচেনা মানুষ আসছেন। নতুন লেখককে একটু প্রকাশিত হয়ে আসতে হবে। নতুন লেখকের কয়েক বছর ধরেই লেখা প্রকাশিত হতে হবে। যাতে তার একটা পাঠক পরিচিতি গড়ে ওঠে। পাঠক পরিচিতি ছাড়া বই বের হয় সেটা পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। একজন নতুন লেখকের যদি পরিচিতি থাকে, তাহলে কিন্তু পাঠকের পক্ষে সুবিধা হয় নতুন বই সংগ্রহ করতে। সাহিত্যে সব সময় নতুন রক্ত প্রবাহিত হওয়া দরকার। নতুন ধারা প্রবাহিত হওয়া দরকার। যারা ২৫, ৩০, ৪০ বছর ধরে লিখছেন, তারা এক ধরনের সিদ্ধি অর্জন করেছেন। কিন্তু নতুন বলতে যে বিষয়টা, সৃষ্টিশীলতা, অভিনবত্ব- সেটা আসলে নতুন লেখকেরাই দেয়। নতুন লেখকদের বেশি বেশি অভ্যর্থনা জানাতে হবে, তাদের পরিচর্যা করতে হবে।

সাইফ বরকতুল্লাহ : নতুন লেখকদের পরিচর্যার দায়িত্বটা কে নেবে?

মারুফ রায়হান : নতুন লেখকদের পরিচর্যার দায়িত্ব প্রথমত সম্পাদকদের নিতে হবে। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে সেরকম সম্পাদক  (সাহিত্য সম্পাদক) নেই। সাহিত্য সম্পাদক জানবেন যে সারা বছর কারা লিখছেন, কারা লিখতে চাইছেন, দেশের বাইরেও নতুন কারা আসছেন। তাদের মধ্যে যদি নতুনত্ব থাকে, অভিনবত্ব থাকে তাদের উৎসাহ দেওয়া, প্রেরণা দেওয়া; এ কাজগুলো সাহিত্য সম্পাদকের কাজ। আমি মনে করি নতুনদের পরিচর্যার জন্য লিটল ম্যাগাজিন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন করতে অনেক পয়সা লাগে। সেক্ষেত্রে অনলাইন হতে পারে একটা মাধ্যম। অনলাইনেও সাহিত্য চর্চা হওয়া দরকার।

সাইফ বরকতুল্লাহ : ভালো একটা প্রসঙ্গ আপনি বলছেন যে অনলাইন। এখন ফেসবুক কিংবা সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সাহিত্যচর্চা করছেন। সেখানে অনেকেই ভালো ভালো লেখা দিচ্ছে, সেটা ছোট হোক, এখানেও কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একটা উন্মেষ হচ্ছে। এ বিষয়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মারুফ রায়হান : অনলাইনে উন্মেষ হচ্ছে। কিন্তু যেকোনো বিষয় অনলাইনে ছাপিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। প্রকাশ করা যাচ্ছে। কিছু কিছু অনলাইন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করে। বাংলাদেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন (অনলাইনে) আমি করেছিলাম। নাম বাংলামাটি। আট বছর আগের কথা। সে সময় আমি একটা মান রক্ষার চেষ্টা করেছি (যেহেতু আমি অনেক পুরনো সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম)। এখন কয়েকটি অনলাইন যেমন ধরেন, রাইজিংবিডি, বিডিনিউজ, এরকম কয়েকটি অনলাইন একটা মান ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু গড়ে যদি আপনি  দেখেন- যেমন ফেসবুক, এখানে তো যেমন ইচ্ছে আমার লেখার কবিতার খাতা হয়ে গেছে। যা ইচ্ছে তাই লেখা হচ্ছে, যে লেখার মধ্যে চিন্তার উন্মেষ নেই। ছন্দ হচ্ছে না তাকে কবিতা বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। এটা কিন্তু ক্ষতিকর। আমি বলতে চাচ্ছি একটা সম্পাদক দরকার। অগ্রজ সাহিত্যিক দরকার। যিনি অভিভাবকের জায়গা থেকে কাজ করবেন এবং গাইড দেবেন।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি তো দীর্ঘদিন ধরেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত। এখন যারা নতুন সাহিত্য সম্পাদনা করতে চান কিংবা যারা এটাকে পেশা হিসেবে নিতে চান- তাদের জন্য আপনার পরামর্শ..

মারুফ রায়হান : আমি চাই নতুন সাহিত্য সম্পাদক আসুক। দায়িত্বশীল সম্পাদক আসুক। যিনি সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ থাকবেন। তার জীবনটাকে সাহিত্যের জন্য উৎসর্গ করবেন। যারা নবীন আসবেন, সাহিত্য সম্পাদনায় আবার সময় দেওয়ার ব্যাপার আছে। কিন্তু বিনিময়ে মূল্য খুব সীমিত। প্রত্যেক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের বেতন খুব কম। সাহিত্য সম্পাদনা করে টিকে থাকা মুশকিল। যদি এখানে অর্থ-বিত্তের দিকে নজর কম থাকে, শিক্ষিত, যিনি একটু বিত্তশালী পরিবারের, এমন যদি সৃষ্টিশীল নবীনেরা আসেন সাহিত্য সম্পাদনায় তাহলে মনে হয় ভালো হবে। যাদের টাকা-পয়সার চিন্তা করতে হবে না। তারা সাহিত্যের জন্য কাজ করে যাবেন। অথবা বিকল্পভাবে আমি বলতে পারি, যারা পত্রিকার মালিক, তাদের সাহিত্য সম্পাদককে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের মর্যাদা দিতে হবে। তাদের ভালো বেতন দিতে হবে ওয়েজবোর্ড অনুসারে। তাহলে তিনি সাহিত্যের জন্য নিবেদিত প্রাণ হবেন।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আমরা যারা সাহিত্যর খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করি, আমরা যারা অনুজ, আপনাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিংবা শহীদ কাদরী ভাইয়েরা যখন ছিলেন, বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিতেন, সেসব আড্ডার মাধ্যমে সাহিত্যের ভাবনা বিনিময় হতো, সাহিত্যের  উৎকর্ষতা ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সে রকম আড্ডাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে..

মারুফ রায়হান : ঢাকা শহর অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। আড্ডা হতে পারে অনলাইনে। চমৎকার হবে। অনলাইনের মাধ্যমে যদি সময় করা যায় তাহলে খুবই ভালো হবে। ধরেন ১০ জন একসঙ্গে অনলাইনে আড্ডা দিচ্ছি, ৩০ জন কমেন্ট করছেন, এটা মজাদার হয়। আমি যেখানেই থাকি না কেন, সেখান থেকেই আমি আড্ডা দিতে পারব। এমনকি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থাকি না কেন সেখান থেকেই আড্ডা দিতে পারব। আপনি বিউটি বোর্ডিংয়ের কথা বলছেন, ও রকম জায়গাতো ছিল আশির দশকে শাহবাগে। সে জায়গাতো এখন নেই। ওইভাবে জায়গাগুলি গড়ে ওঠেনি।

সাইফ বরকতুল্লাহ : রাইজিংবিডিকে সময় দেওয়া জন্য ধন্যবাদ।

মারুফ রায়হান : আপনাকেও ধন্যবাদ। রাইজিংবিডিকে শুভেচ্ছা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়