ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বইমেলা বাঙালির চেতনার নবায়নের মেলা: লুৎফর রহমান রিটন

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বইমেলা বাঙালির চেতনার নবায়নের মেলা: লুৎফর রহমান রিটন

রাইজিংবিডির স্টলে লুৎফর রহমান রিটন (ছবি : ছাইফুল ইসলাম মাছুম)

লুৎফর রহমান রিটন। ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, টেলিভিশন উপস্থাপক, গীতিকার। ১৯৬১ সালের ১ এপ্রিল ঢাকায় জন্ম। বিভিন্ন বিষয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিভাগীয় ও নির্বাহী সম্পাদক ছাড়াও জাপানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি প্রেস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৯-২০০০ বাংলা একাডেমির নির্বাচিত কাউন্সিল সদস্য ছিলেন। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) আসেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাইজিংবিডি ডটকমের স্টলে। এ সময় সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ।

সাইফ বরকতুল্লাহ : দেখতে দেখতে বইমেলা তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেল, শেষ সপ্তাহে চলে এসেছে, কেমন দেখছেন?

লুৎফর রহমান রিটন : বইমেলা তো আমার কাছে সব সময়ই অসাধারণ লাগে। আমার জীবনে যদি উৎসব থাকে কোনো, তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব হচ্ছে বইয়ের উৎসব। এই সময়টার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি সারা বছর। আমি ১২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরের দেশ থেকে উড়ে আসি এই দেশে শুধু এই বইমেলার জন্য এই সময়টায়। আমি থাকি কানাডায়। বরফ প্লাবিত একটা দেশ, আমি অপেক্ষা করি কখন ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি হবে ক্যালেন্ডারে এবং আমি চলে আসব বইমেলায়। বইমেলা যখন শুরু হয়েছিল তখন থেকেই আমি বইমেলায় আসতাম। এবং মাঝখানে শুধু সাত বছরের গ্যাপ ছিল, রাজনৈতিক কারণে আমি দেশে আসতে পারিনি। এই সময় বাদে স্কুলজীবন থেকেই আমি নিয়মিত বইমেলায় আসি। এবারের বইমেলাও আমার কাছে একই রকম আনন্দের, উচ্ছ্বাসের। মেলা বড় হয়েছে। আমি ছোট অবস্থায় মেলা দেখেছি, হাতে গোনা কয়েকটা প্রকাশনা সংস্থা নিয়ে আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই মেলা হতো। তারপর আস্তে আস্তে প্রকাশক বাড়ল, লেখক বাড়ল, পাঠক বাড়ল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রাসারিত হলো। এখন তো স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটাচলা করা যাচ্ছে। তিন সপ্তাহ পর একটা পূর্ণাঙ্গ মেলা দেখে আমার প্রশান্তির শেষ নেই।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি তো বিভিন্ন দেশের বইমেলায় গিয়েছেন। সেখানকার বইমেলা আর একুশে বইমেলার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?

লুৎফর রহমান রিটন : আমি নিউ ইয়র্কের বইমেলায় গিয়েছি। সেই মেলাটা খুবই ছোট্ট মেলা। সেখানে বসবাসরত কিছু বাঙালি থাকে। আর বাইরে থেকে কিছু লেখক আসেন। আসলে নিউ ইয়র্ক, ফ্রাঙ্কফুর্ট, টোকিও বইমেলার সাথে অমর একুশে বইমেলার কোনো তুলনাই হয় না। কলকাতার যে বইমেলা, সেই মেলাও বাংলা একাডেমির বইমেলার সাথে কোনো তুলনা হয় না। আমাদের বইমেলার মতো কোনো বইমেলার সাথে এত প্রাণের আবেগ জড়িত থাকে না। এ মেলা নিছক একটি বই কেনাবেচার মেলা নয়, এর সঙ্গে আমাদের প্রাণের সংযোগ আছে। হৃদয়ের সম্পর্ক আছে, স্বপ্নের সম্পর্ক আছে, শেকড়ের সম্পর্ক আছে। বইমেলায় এলে আমরা নতুন করে উপলব্ধি করি যে ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের আমি নাগরিক এবং বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ- এই তিনটি মূলমন্ত্র একটি বইমেলা ধারণ করে। যে কারণে বাংলা একাডেমির বইমেলা যখন হয়, তখন এই যে বর্ধমান হাউস, বাংলা একাডেমি-  একুশের প্রত্যক্ষ ফসল, ভাষা আন্দোলনের ফসল। এখানে এলে কে আমি, কী আমি- এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব মেলে। শুরু হয়েছে বায়ান্নতে, সেই বায়ান্নর অগ্রযাত্রা নিয়ে এসেছে একাত্তরে এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পরে আমি পেয়েছি স্বাধীনতা। সুতরাং আমার একুশে চেতনা, আমার স্বাধীনতার চেতনা মিলেমিশে একাকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একুশের চেতনা আছে, আবার একুশের চেতনার মধ্যেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্রটি রোপিত আছে। দুটো মিলিয়ে মেলায় এলে আমার চেতনার নবায়ন ঘটে। বইমেলা বাঙালির চেতনার নবায়নের মেলা।

সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা এলেই বই উৎসব হয়, প্রচুর বই প্রকাশিত হয়। মিডিয়ায় ব্যাপক কাভারেজ পায়। কিন্তু বছরের অন্য মাসগুলোতে তা হয় না। সারা বছরই তো বই বের হওয়া উচিত?

লুৎফর রহমান রিটন : সারা বছরই বই বের হওয়া উচিত কিন্তু যেহেতু একুশে উৎসব বিশাল আকার ধারণ করেছে। আমাদের প্রকাশকরা এই সময়টাকেই টার্গেট করেন। আমাদের লেখকরাও সেটা করেন। লেখকরা তাদের পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে সাজান- যেন তার বইগুলো একুশের মেলাতেই প্রকাশিত হয়। এটা আসলে উচিত না। এটা করে যেটা হচ্ছে শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক ফোকাসড হচ্ছে প্রকাশনাটা। অনেক প্রকাশক আছেন তারা প্রতি মাসে অনন্ত একটি বই তারা প্রকাশ করছেন। কিন্তু একুশে বইমেলায় প্রকাশ হলে বাড়তি লাভ হলো মিডিয়া কাভারেজ। যা প্রকাশকরাও চান, লেখকরাও চান। যে কারণে আমাদের প্রকাশনাশিল্প দাঁড়িয়ে আছে বইমেলাকেন্দ্রিক একটা অবস্থানে। এর থেকে বের হওয়া উচিত।

সাইফ বরকতুল্লাহ : প্রতিবছরই বইমেলায় প্রায় কয়েক হাজার বই বের হয়। সমালোচনাও থাকে অধিকাংশ বই সম্পাদনা ছাড়াই বের হচ্ছে। আপনার ভাবনা কী?

লুৎফর রহমান রিটন : আপনার সাথে আজ কথা বলছি (২২ ফেব্রুয়ারি)। আমার কাছে খসড়া একটা হিসাব আছে, সে হিসাব অনুযায়ী তিন হাজার বই অলরেডি বের হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ বাকি আছে। বাইন্ডিং, বাঁধাই, প্রচ্ছদের কারণে যে বইগুলো বের হতে পারেনি, সেগুলো এ সপ্তাহে চলে আসবে। আমি ধরে নিচ্ছি প্রতিবছরের মতো এবারও তিন থেকে চার হাজার বই বের হবে। এর অধিকাংশ বই হচ্ছে মানহীন। পৃথিবীর যেকোনো ভালো প্রকাশনা সংস্থার একটা সম্পাদনা বোর্ড থাকে। সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক ভালোভাবে সম্পাদিত হয়ে বই বের হয়। আমাদের দেশে সেই রেওয়াজটা এখনো চালু হয়নি, বিষয়টি প্রফেশনালিজম অর্জন করেনি। অসম্পাদিত, ভুল বানান, ভুল বাক্য, ছোটদের বই মানহীনভাবে বের হচ্ছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা কবিতায় পড়েছিলাম-‘আসলে কেউ বড় হয় না বড়োর মতো দেখায়’। বইমেলার অধিকাংশ বই বইয়ের মতো দেখতে, কিন্তু একটাও বই না। এতে প্রতারিত হচ্ছেন পাঠকরা।

সাইফ বরকতুল্লাহ : সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বাইরেও বেসরকারি উদ্যোগে কিছু কিছু বইমেলা হচ্ছে। কিন্তু বাংলা একাডেমি কিন্তু একটা কাজ করতে পারে সেটা হলো বিভাগীয় শহরে, জেলা শহরে বইমেলার উদ্যোগ নিতে পারে..

লুৎফর রহমান রিটন : বাংলা একাডেমির দায়িত্ব কিন্তু বইমেলা করা নয়। বাংলা একাডেমি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব যদি বইমেলা করা হয় তাহলে বাংলা একাডেমি তার মূল কাজ থেকে সরে যাবে। একুশের বইমেলাটাও বাংলা একাডেমির দায়িত্ব না কিন্তু যেভাবেই হোক দায়িত্বটা তার কাঁধে অর্পিত হয়ে গেছে। বাংলা একাডেমির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে বইমেলা। এখান থেকে বাংলা একাডেমিকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ, একাডেমির মূল কাজে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনটি মাস বইমেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় একাডেমিকে। বইমেলা সারা দেশে হতে পারে প্রকাশক সমিতি কিংবা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে। বাংলা একাডেমির মাধ্যমে হওয়া উচিত না। একাডেমি কাজ করবে, বইমেলা করবে প্রকাশকরা।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন অপেক্ষায় থাকতাম কখন পত্রিকায় আপনাদের লেখা নতুন ছড়া বের হবে, কিন্তু এখন হৃদয়কে নাড়া দেবে সেরকম সমকালীন ছড়া পাচ্ছি না..

লুৎফর রহমান রিটন : আমি মনে করি সাহিত্যের যেকোনো অঙ্গনে, খুব দ্রুত কয়েক বছরের ব্যবধানে ভালো লেখক পাবেন না। এরকম পেতে হলে আপনাকে লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে। আমরা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে দেশটা আমরা পেয়েছিলাম, সে সময়ের সন্তান তো আমি, যে কারণে একই সঙ্গে আমার চেতনায় ধারণ করি ‍মুক্তিযুদ্ধকে, ধারণ করি আধুনিক বাংলাদেশকে, বিশ্বায়ন। পাকিস্তান আমলটাও দেখেছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখেছি, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় দেখেছি, পরবর্তী আমাদের ক্রমবিকাশগুলো দেখেছি। যে কারণে যতটা সম্পৃক্তটা অনুভব করি, মননে, চিন্তায়, চেতনাগতভাবে, এখনকার তরুণরা হয়তো সেটা  করেন না। না করারই কথা। সময় পাল্টেছে, যুগ পাল্টেছে। আর শিল্পসাহিত্য বাঁচিয়ে রাখে মধ্যবিত্ত। সেটাও পাল্টে গেছে। মধ্যবিত্তের ভেলুস, চরিত্র পাল্টে গেছে। মধ্যবিত্ত বিকশিত হয়েছে। আমাদের সময়ে সংকটের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তরা কাটালেও শিল্পসাহিত্য, বিজ্ঞান, নীতিনৈতিকতামনস্ক ছিল। এখন কেমন যেন চারপাশে এসব কিছুই পাই না। নিমজ্জিত একটা পরিস্থিতি সর্বত্র লক্ষ করি। সবকিছু মিলিয়ে এখন যে তরুণরা লিখছেন তাতেই আমি খুশি। এই নতুনদের মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসবে নতুন কণ্ঠ। নতুন একজন ছড়াকার- যার ছড়া পড়ার জন্য আমি নিজেই অপেক্ষা করে থাকি। আমি হতাশ নই।

সাইফ বরকতুল্লাহ : এখন ফেসবুক কিংবা সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সাহিত্যচর্চা করছেন। সেখানে কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একটা উন্মেষ হচ্ছে। এ বিষয়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

লুৎফর রহমান রিটন : আমি তো খুব আগ্রহ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার লেখাগুলো পড়ি। আমি নিজেও কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একজন নিয়মিত লেখক। ইদানীং পত্রিকায় লিখি না। ফেসবুকেই বেশি লিখি। সেখানে আপলোড করি তারপর বই হয়। অনেক শক্তিশালী লেখক আছেন এই অন্তর্জালে। আমি খুব আশাবাদী।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আমরা যারা সাহিত্যের খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি, আমরা যারা অনুজ, আপনাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিতেন, সেসব আড্ডার মাধ্যমে সাহিত্যের ভাবনা বিনিময় হতো, সাহিত্যের  উৎকর্ষ ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সে রকম আড্ডাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সাহিত্য অঙ্গনে আড্ডা খুব মিস করি...

লুৎফর রহমান রিটন : মানুষ এখন ব্যস্ত হয়েছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষকে এত বেশি ছুটতে হয়, সময়কে কুলিয়ে উঠতে পারা বেশ কঠিন। যানজট নানা কারণে আড্ডা কমে গেছে। এটা জরুরি। আড্ডা সাহিত্য সৃষ্টি করে না কিন্তু আড্ডা সৃষ্টিশীল হতে সহায়তা করে। আড্ডা হচ্ছে একটা ফুয়েল। আড্ডা হওয়া উচিত।

 

সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনাকে ধন্যবাদ
লুৎফর রহমান রিটন : আপনাকেও ধন্যবাদ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়