ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কারখানার বাঁশি শোনা যাচ্ছে

এনামুল রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কারখানার বাঁশি শোনা যাচ্ছে

এনামুল রেজা: উপন্যাস আমাদের দ্বিতীয় জীবন। বাক্যটি আমি পেয়েছিলাম তুরস্কের ঔপন্যাসিক ওরহান পামুকের এক লেখায় (The Naïve and The Sentimental Novelist)। বাস্তবে আমরা যা যাপন করি, উপন্যাসের পৃথিবী ঠিক তার প্রতিফলন নয়। একে ছাপিয়ে আরেক রকম বাস্তব, যা আমরা পড়তে পড়তে অনুভব করতে পারি, বইয়ের পাতার ঐ জগতটি কখনও বা চিরচেনা যাপনের চেয়েও বেশি গাঢ়তরো হয়ে আমাদের হৃদয়ে ছাপ ফেলে।

পাঠক হিসেবে, উপন্যাসের কাছে তাই আমাদের দাবি সামান্য তো নয়ই, বিস্তর। সুতরাং যখন এ ধরাধামের যে কোন প্রান্তের বিবিধ কথাশিল্পীর উপন্যাস পড়তে বসি, নানান ধরনের তৃষ্ণাবোধ ও বিচিত্র মানব জীবনকে চিনে নেবার বাঞ্ছায় আক্রান্তি আসে আমাদের। তাই না?

স্বদেশী লেখকের কোন কাজের ভিতর দিয়ে যাবার সময় উপরোক্ত দাবিগুলো কীভাবে কাজ করে আমাদের ভিতরে? যেহেতু চেনা ভৌগলিক অবস্থানের জন্য নতুন বাস্তবতার ইশারা ঔপন্যাসিকের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক নিজেও খুঁজতে থাকেন। অচেনা লোকের নিকট আমাদের প্রত্যাশা তো কম। কিন্তু আপনাকে নিয়েই যিনি লিখছেন, তার বিষয়ে বলবেনটা কী?

ভূমিকাটি পরিষ্কার করে তুলবার পর মনে হচ্ছে, এবার মূল আলাপে দৃষ্টি রাখা যেতে পারে। তাৎক্ষণিক পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখতে বসেছি হামিম কামালের নতুন উপন্যাস ‘কারখানার বাঁশি’ নিয়ে। সামনে নিশ্চয় আরও বিস্তর আলাপ এ বইটি নিয়ে করবেন প্রাজ্ঞজনেরা। 

মহানগরী থেকে সুদূর এক ট্র্যান্সফর্মার কারখানা আখ্যানটির পটভূমি। এখানে আছে বহু ধরণ ও বরণের শ্রমীক, তাদের উপরে তদারক করতে থাকা অফিসার-ইঞ্জিনিয়ারের দল, অদৃশ্যভাবে আছে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এবং অমোঘরূপে আছে নারী। নতুন কী আছে?

সম্ভবত (নিশ্চিতি নিয়ে কিছু বলবার পক্ষপাতি আমি নই), কথকের অবস্থান। কোথায় দাঁড়িয়ে লেখক গল্পটা শোনাচ্ছেন আমাদের, কার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে? এখানে উপন্যাসটা পড়তে পড়তে নতুন বাস্তবতার সম্ভাবনা পাঠক হিসেবে আমার মনে উঁকি দিতে শুরু করে। অদৃশ্য থেকে কথক বারবার নানান দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, ‘দ্যাখো, শোনো, ঐ দিকে তাকাও’ এভাবে। এবং আমরা দেখছি। শুনছি। অনুভব করছি। শ্রমীকেরা আসছে যাচ্ছে। মহানগর থেকে নতুন একজন ইঞ্জিনিয়ার যোগ দিচ্ছে কারখানায়। তার চোখে দিনের পর দিন একে একে ধরা পড়ছে কারখানাটির ইট-রডের স্তূপ, মেশিনারি থেকে শুরু করে জড়িত সকল মানুষের বিস্তারিত মনস্তাত্ত্বিক বিবরণ। কেন তারা এখানে কাজ করছে, কীভাবে, বেঁচে থাকা নিয়ে তাদের ধ্যান ধারণাই বা কেমন আর একে অন্যের প্রতি তাদের আহ্বান ও প্রত্যাক্ষানের চেহারাটাই বা কী পদের?

এ হলো শুরুর দিকের ধীর কিন্তু গভীর বর্ণনায় উপন্যাসটির জমে ওঠা। পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখক যেন ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন পাঠকের। কিন্তু মানুষে মানুষে ব্যক্তিগত এক ধরনের রাজনৈতিক প্যাঁচঘোচ নিরন্তর চলে। এ নিয়ে যেহেতু আগ্রহের শেষ নেই কারও, ঐ ধীর শুরুটাকে জয় করার ইপ্সাও কি পাশাপাশি জেগে ওঠে না সমান্তরালে? এবং শুনুন, মজাটা বোধ করি ঐ জয়ের পরেই আসবে। পাঠ এগুতে থাকবে তরতর করে।

কারখানায় নতুন কাজ করতে আসা তরুণ প্রকৌশলী সলিলের সঙ্গে নির্বাহী সৌরভ, সহকর্মী মেহেদি, পল্লব আর তারেককে আপনি চিনে ফেলতে চেষ্টা করবেন, দ্বাররক্ষী বৃদ্ধ আলমগীর ও কিশোর রবিকে দেখবেন যে এরা আপনার আশপাশেই আছে, কেউ কেউ হয়ত আপনার মতই। কিন্তু আপনি নন। ওরা কারা তবে? জসিম নামের চরিত্রটির নেতিবাচকতা আপনাকে ব্যথিত করবে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার বেদনার গোপন নদী আবিষ্কৃত হতে পারে আপনার সমুখে। ওদের যার যার নারী, তারা কেমন আছে ওদের সঙ্গে? আখ্যানটি জীবনের নিস্তরঙ্গতার মত, উপরিতল শান্ত অথচ ভিতরে ভিতরে কী ভীষণ জলজ ঘুর্ণি।

যে সময়ে উপন্যাসটি প্রকাশিত হলো, তা অস্থির। আমাদের সামনে অনিশ্চয়তা, বর্তমান অনিশ্চয়তা ও দুঃসময়কে পোক্ত করতেই তা যেন এগিয়ে আসছে। কারখানার বাঁশির গভীরে কি এই দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়াবার আশাবীজ রোপিত আছে?

মানুষের অশুভ বোধের বিপরীতে হামিম কামালের শব্দ ও চরিত্রগুলোকে এক ধরণের শুভবোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে উপন্যাসটির পাতায় পাতায়। সরাসরি এর প্রক্ষেপণ নেই কিন্তু নিতান্ত মন্দ মানুষের ভিতরেও আলো খুঁজে পাবার এক আকুতি যে সলিল লালন করে, তা সে কেন করে?

প্রায় তিনশ পৃষ্ঠার বড় ক্যানভাস এ আখ্যানের। শুরুর কথায় ফিরে যাই, এই পৌনে তিনশ পৃষ্ঠা আপনাকে জীবনের প্রতি কতটা ভাবিয়ে তুলবে আর? সাহিত্য যেহেতু আমাদের চেনা জগতের উপাদান থেকেই তৈরি এক ভিন্ন পৃথিবী, বাস্তব থেকে ভিন্ন হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে সাহিত্যিক বাস্তবতা নিয়ে। বইটিতে তা প্রকট। প্রথম উপন্যাস জঠরের যে নির্মিতি, ‘কারখানার বাঁশি’তে তা থেকে আরেক দিগন্তে পা বাড়িয়েছেন হামিম কামাল। ভাষার ব্যবহারে হয়েছেন আরও সরল ও সংবেদী। এ জন্য তিনি ‘কংগ্রাচুলেশনস’ পাবেন।

মুহূর্তের পাঠে উপন্যাসটির আগামী সম্ভাবনা নিয়ে বলা যাচ্ছে না কিছুই। কিন্তু বাংলা উপন্যাসে নতুন কণ্ঠস্বর শুনবার জন্য যারা আকুল, তারা কি ‘কারখানার বাঁশি’ হাতে নিয়ে স্বস্তি পাবেন? আমি সামান্য পাঠক। আমি কেবল শব্দের ইশারা দিতে পারি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়