ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অণুগল্পের গঠন ও নির্মিতি এবং বিশ্বসেরা ৫ অণুগল্প

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৮, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অণুগল্পের গঠন ও নির্মিতি এবং বিশ্বসেরা ৫ অণুগল্প

|| মোজাফ্‌ফর হোসেন ||

অণুগল্প বা ফ্লাশফিকশন সম্প্রতি সাহিত্যের জনপ্রিয় শাখা হয়ে উঠেছে। গত পাঁচবছর ধরে ব্রিটেনের সাহিত্যজগতে ‘ন্যাশনাল ফ্লাশফিকশন ডে’ উদযাপিত হয়ে আসছে। নিউজিল্যান্ডেও অনুরূপভাবে জাতীয় অণুগল্প দিবস পালিত হয়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের বিপ্লব, ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তায় বর্তমানে গল্পের এই ক্ষুদে কাঠামো বা ফর্ম নিয়ে হৈচৈ হলেও এটি একেবারে নতুন কিছু না— মুখে মুখে বলা গল্প-ঐতিহ্যে (ওরাল ট্রাডিশন) বহুযুগ থেকে চলে আসছে। রূপকথা (Fairy Tale) থেকে আমরা পেয়েছি অণুকাঠামোর গল্প উপকথা (Fable) এবং কথারূপক (Parable)। মোটা দাগে ফেবলের সঙ্গে প্যারাবলের পার্থক্য হলো, ফেবলে সরাসরি হিউম্যান বা মানবচরিত্র থাকে না, কিন্তু প্যারাবলে থাকে। জার্মানিতে গ্রিম ভাইদ্বয় (জ্যাকব গ্রিন ও উইলহেম গ্রিন), ফ্রান্সে পেরোল, ডেনমার্কে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, ইতালিতে বেসিল, ইংল্যান্ডে কাইটলি ও ক্রোকার এসব রূপকথা বা ফোক-টেলস সংগ্রহ করে আদি গল্পের কাঠামো সম্পর্কে আমাদের অবগত করেছেন।

ভারতবর্ষে বৌদ্ধ জাতকের (খৃ.পূ. ৫৩০ অব্দ থেকে খৃ.পূ. ৩৫০ অব্দ) গল্প পঞ্চতন্ত্র, গোপাল ভাঁড়ের গল্প ও ইউরোপে ঈশপের (৪০০ খৃ.পূ. সংকলিত) গল্পও আকারে বেশ ছোট ছিল। তবে আধুনিক অণুগল্প বলতে আমরা যা বুঝি, সেগুলো তা নয়। আধুনিক অণুগল্পের প্রাথমিক কাঠামো সেখান থেকে এসেছে বলে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি।

অণুগল্পে বেঁধে দেওয়া কোনো আকার না থাকলেও কেউ কেউ মনে করেন, এটি ১০০ শব্দের মধ্যে শেষ হওয়া চাই, আবার কেউ কেউ ১ হাজার শব্দের নিচে যে কোনো গল্পকে অণুগল্প বলে মনে করেন। যেমন: মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে(১৮৯৯-১৯৬১) প্রায় নয়শ শব্দে ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’ অণুগল্পটি লিখেছেন; আবার তিনি একটি অণুগল্প লিখেছেন মাত্র ছয় শব্দে: ‘For sale: baby shoes, never worn.’ অন্যদিকে হন্ডুরাসের লেখক অগাস্টো মনটেরেসো (১৯২১-২০০৩) ‘সাত শব্দের এপিক’ বলে বিখ্যাত ডাইনোসর গল্পটি লিখেছেন: `Upon waking, the dinosaur was still there’। প্রখ্যাত মেহিকান লেখক অ্যাডমান্ড ভালাদেস (১৯১৫-১৯৯৪) বারো শব্দে লিখলেন দ্য সার্চ গল্পটি: Those maddened sirens that howl roaming the city in search of Ulysses। একটা অসমাপ্ত বাক্য, কিন্তু গল্প! তবে অণুগল্প নিয়ে যেন একটু বাড়াবাড়িই করে ফেললেন মেহিকোর লেখক গ্যুলার্মো স্যামপেরিও (জ. ১৯৪৮)। তিনি ‘Fantasma’ নামে একটি গল্প লিখলেন যেখানে শিরোনামের পর একটিও শব্দ লেখা হয়নি। শিরোনাম আর একটি খালি পৃষ্ঠা!

অণুগল্পের এই শব্দসীমা চীনাসাহিত্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে ‘স্মোক লং’ ফিকশন বলে। অর্থাৎ একটি সিগারেট শেষ করতে যে সময় লাগবে তার ভেতর এ গল্প শেষ হয়ে যাবে। এটিকে মাইক্রো ফিকশন, পোস্টকার্ড ফিকশন, ন্যানো ফিকশন, সাডেন ফিকশন, সুপার শর্ট ফিকশন কিংবা শর্ট শর্ট স্টোরি নামেও ডাকা হয় বিভিন্ন দেশে।

অণুগল্পে অল্পকথনের ভেতর দিয়ে অনুভবের বিষয়টি উঠিয়ে আনা হয়। প্রখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ার(১৮২১-১৮৬৭)-এর মতো অনেক কবি ক্ষুদে গদ্য-কবিতা (prose poetry) লিখেছেন যেগুলোকে অণুগল্প হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। অন্যদিকে হালের জনপ্রিয় মার্কিন কবি-গল্পকার স্টুয়ার্ট ডাইবেক(জ. ১৯৪২)-এর অনেক অণুগল্প গদ্য-কবিতা হিসেবে কবিতার কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, কবিতা এবং ছোটগল্প দুয়ের বৈশিষ্ট্যই অণুগল্পে বিদ্যমান। যে কারণে মার্কিন কথাসাহিত্যিক জয়েস ক্যারল ওটস(জ. ১৯৩৮) বলছেন, ‘often more temperamentally akin to poetry than to conventional prose, which generally opens out to dramatize experience and evoke emotion; in the smallest, tightest spaces, experience can only be suggested.’

কবিতার মতো অণুগল্পকে নানামাত্রিক অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। একটি কাব্যিক দ্যোতনা বা ভাবমুদ্রা এখানে থাকে। ভাষা হয় ঘন, রূপকাশ্রিত। ফলে মার্কিন কবি-কথাসাহিত্যিক গ্রেস পালে(১৯২২-২০০৭) বলছেন, ‘অণুগল্প কবিতার মতোই ধীরে পড়া উচিত।’ অন্যদিকে অণুগল্প গল্পের মতোই সমাজ বাস্তবতার কোনো সুপ্ত চেতনার প্রতি ইঙ্গিত করে। চরিত্র থাকে, কথোপকথন (ডায়লগ) থাকে। একটা চমৎকার সমাপ্তিও থাকে। কেবল বলাটা হয় দ্রুত— বিদ্যুৎ চমকের মতন ঝলক দিয়েই শেষ। এক মুহূর্তে বর্ণিত বাস্তবতার এক ঝলক দেখে নেয়া।

অণুগল্পের সঙ্গে ছোটগল্পের মূল পার্থক্যটা হলো, ছোটগল্প তৈরি হয় কতগুলো মুহূর্ত নিয়ে; এখানে কতগুলো ঘটনার কতগুলো দৃশ্য আশ্রয় করে প্রকাশ ঘটে। আর একটি সার্থক অণুগল্পে একটি বিশেষ মুহূর্ত একক দৃশ্যপটের ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিছু পরিষ্কার করে বলা হবে না, কেবল একটা ইঙ্গিত দিয়েই ছেড়ে দেয়া হবে। উপন্যাস এবং ছোটগল্পের সঙ্গে তুলনা করে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক লুইসা ভেলেনজুয়েলা (জ. ১৯৩৮) বলছেন: `I usually compare the novel to a mammal, be it wild as a tiger or tame as a cow; the short story to a bird or a fish; the micro story to an insect (iridescent in the best cases)।’

ফ্লাশ ফিকশন শরীরগঠনে ‘পোকা’সদৃশ হওয়ার কারণে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে অতি মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের গল্পে টানটান উত্তেজনা থাকবে। শুরু হতেই শেষ হয়ে যাবে। ছোটগল্পের শেষে চমক থাকতেও পারে, নাও পারে; তবে অণুগল্পে সেটি মৃদুভাবে থাকলে ভালো হয়। যেমন: বনফুলের নিমগাছ গল্পে বনফুল নিমগাছের উপকারী দিকগুলো এবং মানুষের তার প্রতি যে নিষ্ঠুর আচরণ সেটি বলতে বলতে হঠাৎ করে থেমে বলে দিলেন, পাশের বাড়ির বৌটিরও একই দশা। গল্প শেষ। এটা মৃদু চমক। ধাক্কাটা আরো তীব্রভাবে এসেছে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-১৯৮৪)‘উদ্যানের ঘটনার প্রবাহ’ গল্পে। এই গল্পটিসহ বিশ্বসাহিত্যের চমকপ্রদ ৫টি অণুগল্প তুলে ধরা হলো।

উদ্যানের ঘটনার প্রবাহ || হুলিও কোর্তাসার

তিনি কয়েকদিন আগে উপন্যাসটি পড়তে শুরু করেন। এক জরুরি ব্যবসায়িক আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য বইটি পড়া থামিয়ে রাখতে হয়েছিল। ট্রেনে ফেরার পথে আবার খুললেন। ক্রমেই উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্র-চিত্রণের ভেতর নিজেকে নিমগ্ন করলেন। ঐদিন বিকেলে তার এস্টেটের ব্যবস্থাপক বরাবর একটা পত্র লিখে এবং জরুরি আলোচনা সেরে বইটি নিয়ে পড়ার ঘরের মনোরম পরিবেশে বসলেন। এখান থেকে উদ্যানের ওক গাছগুলো দেখা যায়। আরাম-চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে ঘরের দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বেশ আয়েশ করে পড়া শুরু করলেন, কোনোরকম বাধা যেন না আসে পড়াতে। তিনি শেষ অধ্যায়টি পড়া শুরু করলেন। অনায়াসে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নাম ও তাদের অবয়ব তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল। উপন্যাসটি তৎক্ষণাৎ তার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলল যেন।

শব্দে শব্দে উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার দোদুল্যমান গুপ্তচিন্তার ভেতর নিজেকে গেঁথে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন পরিণতির। পাহাড়ের কেবিনে তিনি শেষ দৃশ্যের মুখোমুখি।

প্রথমে নারী চরিত্রটি পৌঁছাল, চেহারায় তার স্পষ্ট উদ্বেগের ছাপ। এরপর তার প্রেমিকের প্রবেশ, গাছের ডালে আঁচড়ে গেছে তার গাল। সোহাগভরা চুমু দিয়ে রক্তপড়া বন্ধ করতে গেল মেয়েটি কিন্তু ছেলেটি সরিয়ে নিলো নিজেকে। বুকে রাখা চাকুটি উষ্ণ হয়ে উঠছে। তার নিচেই অপেক্ষমাণ তাদের প্রেমের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত। তাদের কামোদ্দীপক আলাপ পৃষ্ঠার ভেতর থেকে সাপের মতো হিসহিস করে উঠে আসছিল।

পরিকল্পনা ছিল যথার্থ। সেই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ঠিক কাজে লাগাতে হবে তা। ফের খতিয়ে দেখা হয়েছিল খুঁটিনাটি সব সম্ভাবনা ও শঙ্কা, একটি হাত শুধু একটি গাল ছুঁয়ে আদর করতে পারবে নিশ্চিন্তে, এই আশায়। তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। কেউ কারো দিকে আর না তাকিয়ে তারা তাদের নির্ধারিত কাজের দিকে মন দেয়। কেবিনের দরজার কাছে এসে আলাদা হয় দুজন দুদিকে। নারী চরিত্রটি গেল উত্তর দিকে। প্রেমিক ঘুরে দাঁড়িয়ে তার সাবধানে দ্রুত সরে পড়ার দৃশ্যটি দেখে নিয়ে সেও পাল্টা দৌড় দিল অন্যপাশে। ঝোপের ভেতর দিয়ে হামা দিয়ে বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছাল। কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ করার কথা নয়, তা তারা করেওনি। এস্টেট ম্যানেজারের এই মুহূর্তে এখানে থাকার কথা না। তিনি ছিলেনও না। সে কয়েক পা এগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। কানের কাছে ধপধপ শব্দ ছাপিয়ে প্রেমিকার চাপা কণ্ঠ শোনা যায়— প্রথমে নীলরঙা চেম্বার, এরপর হলরুম, এরপর কার্পেট মোড়ানো সিঁড়ি; উঠেই দুটি দরজা। প্রথম ঘরে কেউ নেই, দ্বিতীয় ঘরে কেউ নেই। তারপর বসার ঘরের দরজা, আর তাপরপ— হাতে উঠে এলো চাকু, বড় খোলা জানালাটি দিয়ে আসছে আলো, আরাম-চেয়ারের উঁচু প্রান্ত আর উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে মগ্ন হয়ে বসে থাকা সেই লোকটির মাথা।

খরগোশ, যারা সকল সমস্যার কারণ ছিল || জেমস থার্বার

সবচেয়ে অল্প বয়সী শিশুটার মনে আছে— নেকড়ে অধ্যুষিত এলাকায় খরগোশদের একটা পরিবার বাস করতো। নেকড়েরা জানিয়ে দিলো যে, খরগোশদের জীবনযাপনের রীতি-নীতি তাদের পছন্দ না। এক রাতে ভূমিকম্পের কারণে একদল নেকড়ে মারা পড়লো। আর দোষ গিয়ে পড়লো খরগোশদের ঘাড়ে। কেননা সবার জানা যে, খরগোশরা পেছনের পা দিয়ে মাটি আঁচড়িয়ে ভূমিকম্প ঘটায়। আরেক রাতে বজ্রপাতে নেকড়েদের একজন মারা পড়লো। আবারো দোষ গিয়ে পড়লো ঐ খরগোশদের ওপরে। কারণ সবাই জানে যে, লেটুস পাতা যারা খাই তাদের কারণেই বজ্রপাত হয়। একদিন খরগোশদের সভ্য ও পরিপাটি করার জন্যে নেকড়েরা হুমকি দিলো। ফলে খরগোশরা সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা নিকটবর্তী দ্বীপে পালিয়ে যাবে। কিন্তু অন্যান্য জন্তু-জানোয়াররা যারা খানিক দূরে বসবাস করতো তারা র্ভৎসনা করে বলল, তোমরা যেখানেই আছ বুকে সাহস বেঁধে সেখানেই থাকো। এ পৃথিবীটা ভীতু-কাপুরুষদের জন্যে নয়। যদি সত্যি সত্যি নেকড়েরা তোমাদের আক্রমণ করে আমরা এগিয়ে আসবো তোমাদের হয়ে।

কাজেই খরগোশরা নেকড়েদের পাশে বসবাস করতে থাকলো। এরপর এক ভয়াবহ বন্যা হলো, সেই বন্যায় আবার নেকড়েদের অনেকেই মারা পড়লো। এবারও যথারীতি দোষ গিয়ে পড়লো ঐ খরগোশ পরিবারের ওপর। কারণ সবাই জানে যে, যারা গাজর কুরে কুরে খায় এবং যাদের বড় বড় কান আছে তাদের কারণেই বন্যা হয়। নেকড়েরা দল বেঁধে খরগোশদের, তাদের ভালোর জন্যেই, ধরে নিয়ে গেল এবং তাদের নিরাপত্তার জন্যেই তাদের একটি অন্ধকার গুহার ভেতরে আটকে রাখলো।

যখন কয়েক সপ্তাহ ধরে খরগোশদের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না; সাড়াশব্দ না পেয়ে অন্যান্য জন্তু-জানোয়াররা নেকড়েদের কাছে জানতে চাইলো খরগোশদের ব্যাপারে। নেকড়েরা জানালো যে, খরগোশদের সাবাড় করা হয়ে গেছে। যেহেতু তারা সাবাড় হয়ে গেছে সেহেতু এটা এখন তাদের একান্ত নিজেদের বিষয়। কিন্তু অন্যান্য জন্তুরা হুমকি দিয়ে জানালো, যদি খরগোশদের খাওয়ার উপযুক্ত কোনো কারণ না দেখানো হয় তাহলে তারা সব একত্রিত হয়ে নেকড়েদের বিপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সুতরাং নেকড়েদের একটি যুৎসই কারণ দেখাতেই হলো। তারা বলল, খরগোশরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল এবং তোমরা ভালো করেই জানো যে পলাতক-কাপুরুষদের জন্যে এ দুনিয়া না!

আইনের দরজায় || ফ্রানৎস কাফকা

আইনের দোরগোড়ায় অপেক্ষমান এক দারোয়ান। এই দারোয়ানের কাছে গ্রাম থেকে আগত এক লোক এসে প্রবেশ অনুমতির প্রার্থনা করে। কিন্তু দারোয়ান বলে যে, সে তাকে ঠিক এই মুহূর্তে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতে পারছে না। লোকটা ক্ষণিক ভেবে জিজ্ঞাসা করে, খানিক পরে ঢুকতে দেওয়া যায় কিনা। ‘তা সম্ভব’, দারোয়ান বলে, ‘তবে এই মুহূর্তে নয়’। যেহেতু আইনের দরজাটা খোলা আছে এবং দারোয়ান এক পাশে সরে আছে, উৎসুক লোকটি উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা চালায়। এটা দেখে হেসে উঠে দারোয়ান বলে, ‘যদি তোমার এতই ইচ্ছে হয়, আমার বাধা না মেনে ভেতরে চলে যেতে পারো। তবে মনে রেখ, আমি ক্ষমতাবান। এবং আমি হচ্ছি সবচেয়ে নিচুপদের দারোয়ান। ভেতরে হল থেকে হলে একজন করে দারোয়ান আছে। প্রত্যেকে তার আগের জনের থেকে শক্তিধর। তৃতীয় দারোয়ানের চোখেই আমি চোখ রাখতে পারি না।’

গ্রাম থেকে আসা লোকটি এতসব জটিলতার কথা ভেবে এখানে আসেনি। সে ভেবেছে, নিশ্চয় আইনে সবার সবসময় সমান প্রবেশাধিকার আছে। কিন্তু এখন সে যখন দারোয়ানকে আরো কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করল— ফারের কোট পরা, লম্বা সরু নাক, লম্বা-পাতলা-কালো তাতারদের দাড়ি, সে সিদ্ধান্ত নিল— সে বরং অপেক্ষা করবে। দারোয়ান তাকে একটা মুড়া দিয়ে দরজার একপাশে বসার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সে ওখানে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বসে কাটিয়ে দেয়। মাঝে সে বেশ কয়েকবার ভেতরে প্রবেশের জন্যে আর্জি করেছে। প্রতিবারই দারোয়ান কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করেছে, জানতে চেয়েছে তার বাড়িঘর সম্পর্কে, আরো অন্যান্য সব বিষয় নিয়ে। এগুলো খালি পদস্থ লোকদের একটু ভাব ধরে কিছু কথা বলার মতোই। এবং প্রতিবারই শেষ করেছে এই বলে যে, এখনও তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার সময় আসেনি। লোকটি তার ভ্রমণের জন্য যতকিছু সঙ্গে এনেছিল, দামি অদামি সব, আস্তে আস্তে ঘুষস্বরূপ দারোয়ানকে দিয়ে দিলো। দারোয়ান প্রতিবারই এটা গ্রহণ করে বলেছে— ‘আমি শুধু এটা গ্রহণ করছি, যাতে তুমি নিজেকে নিজে বলতে পারো সব চেষ্টা তুমি করেছিলে।’

এই অনেকগুলো বছরে দারোয়ানের দিকে লোকটির মনোযোগ প্রায় আটকে গিয়েছিল। সে অন্যান্য দারোয়ানদের কথা ভুলেই গিয়েছিল। এই প্রথম দারোয়ানকেই তার কাছে আইনের পথে মূল বাধা বলে মনে হচ্ছিল। শুরুর বছরগুলোকে সে তার মন্দ ভাগ্যকে গালমন্দ করছিল— ভীষণ রেগে আর উচ্চবাচ্যে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে খালি নিজেকে তার অসন্তুষ্টি বিড়বিড় করে জানান দিচ্ছিল। বাচ্চা বনে যায় সে। দারোয়ানকে এতটা কাল ধরে দেখতে দেখতে তার কোর্টে বসা মাছিগুলোও পরিচিত হয়ে ওঠে। মাছিগুলোর কাছেও সে মিনতি করে দারোয়ানের মন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার জন্যে। শেষমেশ তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে। সে বুঝে উঠতে পারে না, তার আশপাশে ঐগুলো অন্ধকার নাকি চোখের ধোকা। তবে ঐ অন্ধকারের ভেতর থেকেই সে উপলব্ধি করতে পারে, আইনের দরজা থেকে একটা অনির্বাণ দীপ্তি ভেসে আসছে। আর বেশি দিন বাঁচবে না সে। মৃত্যুর আগে, এতদিন ধরে সংগৃহীত সকল অভিজ্ঞতা তার মাথায় জড় হয়ে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়— একটা প্রশ্নে যেটা সে এখনও দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেনি। সে হাত নাড়িয়ে দারোয়ানের দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করে, যেহেতু উঠে দারোয়ানের কাছে যাওয়ার মতো শক্তি আর অবশিষ্ট নেই তার দেহে। দারোয়ানকে এগিয়ে আসতে হলো। তাকে ঝুকে আসতে হয় কেননা দুজনের শরীরের উচ্চতার ফারাকে অসুবিধা হচ্ছিল। ‘এখন আবার তুমি কি জানতে চাও?’ দারোয়ান জানতে চাইল, ‘তোমার তৃপ্তি কোনোদিনই মেটানো সম্ভব না।’

‘প্রত্যেকেই তো আইনের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে,’ লোকটি বলল, এটা কি করে সম্ভব হলো যে এতকাল ধরে আমি ছাড়া আর কেউ আইনের কাছে যাওয়ার জন্যে এলো না?’

দারোয়ান বুঝতে পারলো যে, লোকটি তার জীবনের চরম সীমায় চলে এসেছে। সে আর ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছিল না, দারোয়ান কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল, ‘যেহেতু এই দরজা শুধু তোমার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল, সেহেতু আর কেউ ভেতরে ঢুকতে পারত না। আমি এখন এটা চিরকালের মতো আটকে দিতে যাচ্ছি।’

বার্লিন || ম্যারি বয়লি ও’রেইলি

একটি ট্রেন হামাগুড়ি দিয়ে বার্লিন ছেড়ে আসছিল। ট্রেনের প্রতিটি বগি নারী ও শিশুতে গিজগিজ করছে। সুস্থ-সবল দেহের পুরুষ মানুষ সেখানে ছিলো না বললেই চলে। একজন বয়স্ক মহিলা ও চুলে পাকধরা সৈনিক পাশাপাশি বসা। মহিলাটিকে বেশ রুগ্ন ও অসুস্থ দেখাচ্ছিল। তিনি গুনে চলেছেন, ‘এক, দুই, তিন’— ট্রেনের মতোই আপন ধ্যানে ক্ষণিক বিরতি দিয়ে। ট্রেনের একটানা ঝিকঝিক শব্দের ভেতরেও যাত্রীরা তার গণনা দিব্যি শুনতে পায়। দুটি মেয়ে বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করছিল। বোঝায় যাচ্ছে, তারা মহিলার গণনা শুনে বেশ মজা মেয়েছে। মেয়ে দুটোকে উদ্দেশ্য করে একজন মুরুব্বী গোছের লোক বিরক্তিসূচক গলা খ্যাঁকানি দিয়ে উঠলে কক্ষটিতে একধরনের হালকা নীরবতা এসে ভর করলো।

‘এক, দুই, তিন’— মহিলাটি শব্দ করে গুনলেন, যেন পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র বাসিন্দা। মেয়ে-দুটি আবারও খুকখুক করে হেসে উঠলো। বোঝা গেল তারা হাসিটা চেপে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। পাশে বসা বয়স্ক সৈনিক সামনের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে ভারী গলায় বললেন: ‘শোনো মেয়েরা, আশা করি আমার কথাগুলো শোনার পর তোমরা আর হাসবে না। এই অসহায় মহিলাটি আমার স্ত্রী। কিছুক্ষণ আগেই আমরা যুদ্ধে আমাদের তিন সন্তানকে হারিয়েছি। যুদ্ধের সম্মুখভাগে অগ্রসরের আগে আমি তাদের মাকে একটা বিকারগ্রস্ত চিকিৎসাকেন্দ্রে রাখতে যাচ্ছি।’

কক্ষটিতে ভয়ঙ্কর নীরবতা এসে ভর করলো।

কীভাবে সে প্রায়শই ঠিক ছিল || লিডিয়া ডেভিস

প্রায়ই আমি ভাবি যে, আমরা কি করবো না করবো এ-ব্যাপারে তার ধারণাটা ভুল, এবং আমারটাই ঠিক। যদিও আমি জানি, আগে তার অনেক সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল। এবং ভুল আগে আমিও খানিকটা করেছি। কাজেই আমি তাকে ঐ ভুল সিদ্ধান্তটা নিতে দেই; নিজেকে বোঝাই, যদিও আমি তখনো মনে করি না যে, তার ভুল সিদ্ধান্ত কখনো সঠিক হতে পারে। পরে দেখা গেলো, আগেও এমন হয়েছে, তার সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল। মোটের ওপর তারপরও তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কিন্তু তা ভুল ছিল প্রকৃত অবস্থাভিন্ন অন্য কোনো পরিস্থিতির জন্যে। সেই একই সিদ্ধান্ত আবার সঠিক ছিল এমন সব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যেগুলো আমি কখনই পরিষ্কারভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়