ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দিনাজপুর মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস শুক্রবার

নজরুল মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দিনাজপুর মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস শুক্রবার

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর : দিনাজপুর জেলার ইতিহাসে বেদনাবিধুর দিন ৬ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের এ দিনে দিনাজপুর শহরের মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলের ট্রানজিট ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন।

 

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীনের পর দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীর গিরিজানাথ হাই স্কুলে স্থাপন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে সমবেত হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলার মুক্তিযোদ্ধারা। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পতিরাম ও বাঙ্গালবাড়ী ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখানে সমবেত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল আট শতাধিক। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে শত্রুদের পুঁতে রাখা মাইনমুক্ত করতে সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করছিলেন। ক্যাম্প থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়তেন পাক সেনাদের পুঁতে রাখা মাইন, অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের সন্ধানে। সন্ধ্যার দিকে উদ্ধারকৃত মাইন ও অস্ত্র জমা করা হতো স্কুলের দক্ষিণাংশে খনন করা বাংকারে।

 

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রুটিন ওয়ার্কের এক পর্যায়ে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। উদ্ধারকৃত অস্ত্র বাংকারে নামানোর সময় অসতর্ক মুহূর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন পড়ে যায়। এতে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংকারের পুরো অস্ত্রভাণ্ডার বিস্ফোরিত হয়। ভয়াবহ ও বিকট বিস্ফোরণে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয় স্কুল প্রাঙ্গণসহ এর আশপাশের এলাকায়। এতে পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বহু সংখ্যক আহত হন।

 

এ দুর্ঘটনায় আহত দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার চরাড়হাট গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, সে দিন মাইন বিস্ফোরণে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার পূর্বে ৫০ থেকে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। এ দুর্ঘটনায় সাড়ে চারশত মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। দুর্ঘটনার পরপরই শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিসেন্ট মিশন হাসপাতালে। এদের মধ্যে ২৯ জন মারা যায়।

 

আব্দুর রশিদকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে ১৭ দিন চিকিৎসার পর তার জ্ঞান ফিরেছিল। পরে ভারতের কলকাতার একটি হাসপাতালে সাড়ে ৪ মাস চিকিৎসার পর বাম পা কেটে ফেলে দেশে ফিরে আসেন। এখন এ পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সরকারি ভাতা পান। ওই দুর্ঘটনায় তার মতো আরো ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন স্থানে জীবিত থেকে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। 

 

দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও ৬ জানুয়ারি স্মৃতিপরিষদের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটু জানান, ঘটনার সময় তিনি তার শহরের বাসাতে অবস্থান করছিলেন। দুর্ঘটনার পর শহরের সকল স্তরের মানুষ ঘটনাস্থলে গিয়ে জীবিত ও মৃতদের উদ্ধার করে। যারা আহত ছিল, তাদের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সে সময় হাসপাতালে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক ও ওষুধপত্র না থাকায় ঠিকমত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

 

তিনি জানান, সে দিনের ওই মাইন বিস্ফোরণে শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, শহরের উত্তরবালুবাড়ী কুমার পাড়া মহল্লার ১৫ জনের মৃত্যু হয়। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় স্কুলের দ্বিতল ভবনসহ আশপাশের অধিকাংশ ঘরবাড়ি।

 

দুর্ঘটনার পরদিন ৭ জানুয়ারি দিনাজপুর গোরা শহীদ ময়দানে শহীদদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে সামরিক মর্যাদায় ১২৫ জন শহীদের লাশ দাফন করা হয় ঐতিহাসিক চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে। এরপর চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে হাসপাতালে মারা যাওয়া আরো ১৯ জনের দাফন করা হয়।

 

দিবসটি পালন উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ প্রতি বছরের মতো এবারো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শুক্রবার সকালে   চেহেলগাজী মাজারে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি ও স্কুলের শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, সকাল ১০ টায় প্রেসক্লাব চত্বরে আলোচনা সভা, আবৃত্তি ও গণসঙ্গীতানুষ্ঠান। বাদ জুমআ মহারাজা স্কুল জামে মসজিদে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।

 

 

রাইজংবিডি/রংপুর/৬ জানুয়ারি ২০১৭/নজরুল মৃধা/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়