ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

চিংড়ি চাষে রাজত্ব বড় ঘের মালিকদের

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চিংড়ি চাষে রাজত্ব বড় ঘের মালিকদের

রফিকুল ইসলাম মন্টু, খুলনার পাইকগাছা ঘুরে : মাঠে মাঠে চিংড়ি চাষের প্রস্তুতি। ঘের খনন, বাঁধ তৈরি, ওষুধ ছিটানোসহ বিভিন্ন কাজ চলছে পাইকগাছার চিংড়ি ঘের এলাকায়। আর ক’দিন পরেই মাঠে পানি উঠবে। ছাড়া হবে চিংড়ির পোনা। কিন্তু এ এলাকায় চিংড়ি চাষ করছে যে যার মতো করে। বড় ঘের মালিকেরা নিজের প্রয়োজনে ঘেরে পানি উঠাচ্ছে, নামাচ্ছে।

চিংড়ি ঘের এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে পানি উঠানো-নামানোর ফলে ক্ষতি হচ্ছে বাঁধের। সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় ঘের এলাকায় কোথাও দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। বিলের ভেতরের খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ঘের মালিকেরা স্থানীয় ক্ষুদ্র চাষিদের জমি লিজ নিয়ে শত শত বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করছে। আর এসবের প্রভাব পড়ছে জনজীবনে।

পাইকগাছার ভিলেজ পাইকগাছাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ঘের এলাকায় বড় চাষিদের দাপটে ছোট চাষিরা পড়ছে বিপাকে। পঞ্চাশ কিংবা শত বিঘা জমির ঘেরের পাশে দুই-তিন বিঘা জমির মালিকেরা ঘের করতে পারছেন না। বড় ঘেরের মালিকেরা পানি উঠাতে-নামাতে গেলে ক্ষুদ্র চাষিরা তাদের জমিতে ধানও চাষ করতে পারেন না, মাছ চাষ করতে পারেন না। ফলে বাধ্য হয়ে জমি লিজ দিতে হয় বড় ঘের মালিকের কাছে। লিজের বিনিময়ে পাওয়া সামান্য টাকার বিনিময়ে জমি আটকা পড়ে যায় বছরের পর বছর।

সরেজমিন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পাইকগাছার চিংড়ি চাষ এলাকায় খালগুলো হারিয়ে গেছে। আগে বিলের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া এ খালগুলো দিয়ে পানি চলাচল করত। চাষিরা প্রয়োজনমতো পানি উঠা-নামা করিয়ে চাষাবাদ করত। ওই খালগুলো এখন বড় মালিকদের ঘেরের ভেতরে চলে গেছে। নীতিমালা না থাকায় সরকার খাস খালগুলো বন্দোবস্ত দিচ্ছে। এরফলে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।

সূত্র বলছে, চিংড়ি চাষ এলাকায় বাইরে থেকে আসা অনেক বড় বড় মালিকেরা ঘের করেছেন। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঘেরে পানি উঠাচ্ছেন, নামাচ্ছেন। কোথাও নিজেরাই স্লুইস গেট বানিয়ে নিয়েছেন পানি উঠানো-নামানোর জন্য। নিজের টাকায় করা স্লুইস গেট দিয়ে তারা পাশের অন্য ঘেরের পানি উঠানো-নামানো করতে রাজি নন। এরফলে আরেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।

 



সোলদানা এলাকার চাষি চিত্তরঞ্জন মন্ডল বলেন, ‘ধানের চেয়ে আমরা মাছ চাষেই বেশি লাভবান হই। সে কারণে ধান বাদ দিয়ে সবাই মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছে। মাছ চাষে সুষ্ঠু নীতিমালা থাকলে মাছ চাষ করলেও অনেকে একই জমিতে সুবিধামত ধান চাষ করতে পারত। ভিলেজ পাইকগাছা, লস্করসহ কয়েকটি এলাকার চাষিদেরও একই দাবি। তারা মাছ চাষের জন্য নীতিমালা চান।’

আশির দশকে এ এলাকায় চিংড়ি চাষ শুরু হলে এর বিরদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। চিংড়ি বিরোধী এ আন্দোলন চিংড়ি চাষ ঠেকাতে পারেনি। পর্যায়ক্রমে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হতে থাকে। এরপর চিংড়ি চাষের জন্য সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নের দাবি ওঠে। দীর্ঘ আন্দোলনের পরে খসড়া নীতিমালা তৈরি হলেও তা এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। ফলে চিংড়ি চাষ হচ্ছে দাপটশালী ঘের মালিকদের ইচ্ছামত।

চিংড়িচাষ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘের এলাকায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই বলে চিংড়ি চাষে নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বছরে বছরে ভাইরাসে মারা যাচ্ছে লাখ লাখ টাকার চিংড়ি। এরফলে ঘের মালিকেরা লোকসান গুনছে। কিন্তু নীতিমালা থাকলে এটা হয়ত ঠেকানো যেত। চিংড়ি থেকে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাইকগাছা মৎস্য বিভাগের একজন ফিল্ড সহকারী বলেন, ঘের করার কোনো নীতিমালা নেই। নীতিমালা থাকলে চিংড়ি চাষ থেকে আরও বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। বর্তমানে পাইকগাছায় ৩ হাজার ৯৪০টি চিংড়ি ঘের রয়েছে, যার আয়তন ১৭ হাজার ৭৫ হেক্টর।

 



পাইকগাছা উপজেলা কৃষি বিভাগের মতে, পরিবেশ-প্রকৃতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে গরু-বাছুর যেমন দরকার, তেমনি ধান-মাছও দরকার। ধান ও মাছ উভয় আবাদ কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন নীতিমালা।

পাইকগাছা ধান-মাছ-পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটি বলছে, নীতিমালার জন্য এলাকার মানুষের পক্ষ থেকে কিছু দাবি তোলা হয়। প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঘেরের আকার ৩০ থেকে ৫০ বিঘা হতে হবে। প্রতিবছর লিজের টাকার পরিমাণ বাড়াতে হবে। জমিতে বছরে একবার ধান চাষ করতে হবে। ঘের এলাকায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ধান চাষের আগে লবণ পানি বের করে দিতে হবে। এইসব দাবির কতটা নীতিমালায় প্রতিফলন হচ্ছে, তা এলাকার মানুষ জানে না।

পাইকগাছার রয়েল মৎস্য খামারের মালিক গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, ‘আমরা যতটা সম্ভব পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রাখি। তবে এ এলাকাটি তো আগে থেকেই লবণাক্ত। এখানে অন্য কোনো ফসল তেমনটা হয় না। নীতিমালা হলে সবার জন্যই ভালো।’



রাইজিংবিডি/পাইকগাছা/২৭ জানুয়ারি ২০১৭/মন্টু/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়