ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

গাবুরার সংকটকাল কাটছে না

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গাবুরার সংকটকাল কাটছে না

রফিকুল ইসলাম মন্টু, শ্যামনগরের গাবুরা ঘুরে : ছোট হয়ে আসছে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। কপোতাক্ষ আর খোলপেটুয়া নদীর অব্যাহত ভাঙণ হাজার হাজার মানুষকে নি:স্ব করেছে। নতুন বাঁধ দেওয়া হচ্ছে, আবার সে বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। নি:স্ব মানুষগুলো আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধের পাড়ে। জীবন যাপনের ন্যুনতম সুবিধা এখানে নেই। সরকারি সুবিধা পৌঁছায় সামান্যই। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর এই এলাকার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বহু মানুষ এখনও আইলার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের এই ইউনিয়নটি উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন। একদিকে কপোতাক্ষ, অন্যদিকে খোলপেটুয়া বয়ে গেছে সুন্দরবনের দিকে। খোলপেটুয়া নদীর ওপারেই সুন্দরবন। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ ইউনিয়নের নানা সমস্যার মাঝে নদীভাঙণ এখানকার মানুষদের প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে।

নদীভাঙ্গণে একজন নি:স্ব শহীদুল্লা গাজী। বাড়ি গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া গ্রামে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এখন নি:স্ব। পরিবার পরিজনসহ বসবাস করেন বাঁধের ওপর। এক সময় ১৩ বিঘা জমি ছিল তার। সে জমিতে ছিল চিংড়ির ঘের। ভাইদের পরিবার মিলে ৩৫ জনের সংসার ভালোই চলতো এতে। এখন কাজকর্ম করে কোন মতে জীবিকা নির্বাহ করেন।

শহীদুল্লাহ গাজী বলেন, ‘বাঁধের ওপর বসবাস করতে নানা ধরণের সমস্যা হয়। বাঁধ ভেঙে গেলে কিংবা বাঁধ তৈরির সময় অন্যত্র চলে যেতে হয়। অসুখে পথ্য মেলেনা। জরুরি স্বাস্থ্য সেবার জন্য খুলনার কয়রা কিংবা সাতক্ষীরার শ্যামনগর যেতে হয়। নদী পেরিয়ে সেখানে যেতে রয়েছে ঝুঁকি। নির্বাচনে ভোট দিলেও আমাদের জন্য সুবিধা মেলে সামান্যই।’

লেবুবুনিয়ার বাসিন্দারা জানান, এখান থেকে শ্যামনগর যেতে হলে কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদী পার হতে হয়। দূরত্ব প্রায় ৪৫কিলোমিটার। অন্যদিকে কয়রা যেতে হলে কপোতাক্ষ পার হতে হয়। প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ যেতে হয়। মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে এলাকার মানুষ চরম বিপাকে পড়েন। অন্যদিকে দুর্যোগের সময় তাদের সংকটের শেষ থাকেনা। নেই সাইক্লোন শেল্টার। ঝড়ের সংকেত পেলে ভয় হয়। জীবন বাঁচানোর কোন উপায় নেই।

মহিবুল্লা গাজীর স্ত্রী নাহারুন বেগম বলেন, ‘বাড়িঘর নদীতে ভেঙে যাওয়ায় এই বাঁধের ওপর বাসা বানিয়ে থাকি। কাজ করে রোজগার হলে চাল কিনে ভাত খাই, রোজগার না হলে ধারকর্জ করে চলতে হয়।’

স্বামী-স্ত্রী মিলে কখনো মাটির কাজ, কখনো ইটভাটায় কাজ করেন। এভাবেই কোন মতে সংসার চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

গাবুরার নদীভাঙণ এলাকা ঘুরে নি:স্ব মানুষের সংকটের চিত্র চোখে পড়ে। এলাকায় ফসলি জমি কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে কাজের সুযোগ। চিংড়ি ঘেরে কাজ পায় সামান্য কিছু লোক। সুন্দরবনের কাজও আগের চেয়ে কমে এসেছে। জমিজমা ভেঙে যাওয়ার আগে ভাঙণ কবলিতদের এতটা দুর্দিন ছিলনা। এখন জীবিকার সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ মাসের পর মাস বেকার থাকে।

স্থানীয় লোকজন জানান, কাজের সন্ধানে এখানকার বহুমানুষ বাইরের শহরে যায়। শীত মৌসুমে বেশিরভাগ মানুষ ইটভাটায় কাজ করতে যায়। তারপরও তিনবেলা ভাত জোটানো মুশকিল। অনেকে দু’বেলা কিংবা একবেলা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। দু:স্থদের জন্য সরকারি সাহায্য এখানে কমই আসে। সামান্য পরিমাণ বরাদ্দ এলেও তা সীমিত সংখ্যক মানুষ পায়। কেউ কেউ আবার এনজিওদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে।

গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়নের সাত হাজার ছয়শ’ পরিবারের মধ্যে অন্তত চার হাজার পরিবার নদীভাঙণে ক্ষতিগ্রস্থ। ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের গাগড়ামাটিয়া থেকে জালিয়া খালী খগেন বাবুর বাড়ি পর্যন্ত দশ কিলোমিটার কপোতাক্ষের ভাঙণের কবলে রয়েছে। নয় নম্বর ওয়ার্ডের নয় নম্বর সোরাগ্রাম থেকে দৃষ্টিনন্দন পর্যন্ত দুইকিলোমিটার খোলপেটুয়ার ভাঙণের শিকার। আট নম্বর ওয়ার্ডের চকবারা থেকে খোলপেটুয়া কালিবাড়ি মন্দির পর্যন্ত আট কিলোমিটার খোলপেটুয়া নদীর ভাঙ্গণের শিকার। পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদনি মুখার গেট থেকে টেকের হাটের মসজিদ পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার খোলপেটুয়ার ভাঙ্গণের শিকার।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ২০০৯ সালে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা এই দ্বীপ ইউনিয়নের বহু মানুষকে নি:স্ব করেছে, পথে বসিয়েছে। গোটা দ্বীপ লবণ পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। চারপাশের বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছিল হাজারো পরিবার। অনেকে আশ্রয়ের জন্য ছুটে গিয়েছিল শ্যানগরের মূল ভূখন্ডে। আইলার প্রলয়ে নি:স্ব হওয়ার পর বহুমানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে কাজের সন্ধানে। জীবিকা নির্বাহে এলাকায় তেমন কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

আলাপ হলো ইউনিয়নের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে। শক্ত বেড়িবাঁধের দাবির সঙ্গে অনেকে যোগ করলেন কর্মসংস্থানের প্রকল্প গ্রহণের। তিন নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার নবীন্দ্রনাথ মন্ডল জানালেন, নদীভাঙণে ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ। ভাঙণরোধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা। অন্যদিকে ভাঙণে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্যও নেই কোন বরাদ্দ। মানুষগুলোর পুনর্বাসন আর কাজের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়