উ প কূ লে র প থে
বাঘের থাবায় প্রাণ, তবুও বনেই জীবিকা
রফিকুল ইসলাম মন্টু, খুলনার কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ঘুরে : বাঘের থাবায় মানুষের জীবন যাওয়ার ঘটনা এখানে অহরহ। সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম ঘুরলে এ তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। বাবা, চাচা, বড়ভাই, স্বামী বাঘের পেটে গেলেও সেই বাঘের সামনেই রোজগারের পথ। সুন্দরবনে না গেলে সংসার চলে না। কাঠকাটা, গোলপাতা কাটা, কাঁকড়া ধরা, মাছধরা, মধু আহরণেই এই এলাকার মানুষের জীবিকা। খাবার যোগাড় করতে গিয়ে খেটে খাওয়া মানুষেরা নিজেরাই বাঘের খাবার হয়।
সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম কয়রার মঠবাড়ি, কয়রা পাঁচ নম্বর, পাথরখালী, কাঠকাটা, গোলখালী, আংটিহারা, ঘড়িলাল, শ্যামনগরের নাপিতখালী, লেবুবুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার বহু মানুষ বাঘের থাবায় প্রাণ দিয়েছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যুতে এক একটি পরিবার পথে বসেছে। বহু নারী ‘বাঘ বিধবা’ হয়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়েছেন।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের গোলখালী গ্রামে শাকবাড়িয়া নদীর ধারে আফসার শেখের দোকানে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে বাঘের হিংস্রতার নানা তথ্য মেলে। তারা জানান, কারও একখানা হাত কিংবা পা, আবার কারও মুখমন্ডল উদ্ধার করা হয় বাঘের মুখ থেকে। আবার কারও কোন সন্ধানই মেলে না। বাঘের আক্রমনের খবর পেয়ে এলাকার লোকজন ছুটে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। এই রেওয়াজ চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। উদ্ধার করা যাক বা না যাক, খবর পেয়ে এলাকার একদল মানুষ ছুটে যাবেই। তবে জীবিত উদ্ধারের সংখ্যা খুবই কম।
পাঁচ বছর আগে বাঘের পেটে গেছেন গোলখালী গ্রামের আ. হাকিম মোল্লা । দু’মেয়ে রাফেজা ও আফেজাকে নিয়ে ফজরের সময় বনের খালে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মেয়ে দু’টো তার কাছ থেকে একটু দূরে ছিল। এরইমধ্যে আকস্মিকভাবে বাঘের আক্রমনে পড়েন হাকিম। মেয়েরা বাড়ি ফিরে খবর জানালে এলাকা থেকে একদল লোক সেখানে যায় আ. হাকিমকে উদ্ধার করতে। মুখমন্ডল আর একখানা পা উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বাকিটা খেয়ে ফেলেছিল বাঘ।
২০০৯ সালের আইলার পরে বাঘের পেটে যাওয়া আরেকজন গোলখালীর ওয়াসকুরুনি । তিনিও ভোরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মাছ ধরার পাশাপাশি মধুও আহরণ করেন। সঙ্গে ছিল দুই ভাই আর জামাতা। গাছে উঠে মৌচাক কাটতে গেলে ওয়াসকুরুনিকে বাঘে ধরে। সঙ্গে থাকা অন্যরা ফিরে এলাকায় এসে খবর জানায়। লোকজন গিয়ে বাঘের মুখ থেকে মাত্র একটি হাত উদ্ধার করতে পেরেছে।
আবদুর রশিদ মোল্লার বাবা আব্বাস মোল্লাকে বাঘে নিয়েছে দশ বছর আগে। তিনি বনে জোংরা নামের এক প্রকার শামুক সংগ্রহ করতেন। এ শামুক দিয়ে চুন তৈরি করা হয়। আব্বাস মোল্লাকে বাঘে নেওয়ার পর তার পরিবারে নেমে আসে চরম সংকট। কিশোর রশিদ মোল্লাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। তাকেও জীবিকার প্রয়োজনে ছুটতে হয় সুন্দরবনে। এখনও তিনি বনের কাজেই জীবিকা নির্বাহ করেন।
বাঘের আক্রমনে প্রাণ হারানো মানুষের নাম লিখতে গেলে তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। এলাকাবাসী জানালেন, গোলখালীর আবুল বাসার গাজী, নজরুল ইসলাম ঢালী, আ. ছত্তার গাজী, আবদুল মজিদ শেখ, মাটিয়াভাঙার রাজ্জাক খান, শাহীনুর গাজী, আতাহার আলী মোল্লা, কয়রা পাঁচ নম্বর এলাকার আবু তালেব, সোবাহান গাজী, নুরুদ্দিন, আজিজ গাজী, আহম্মদ সানা, শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া গ্রামের আতিয়ার রহমানসহ বহু মানুষ বাঘের আক্রমনে জীবন দিয়েছে।
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া গ্রামের রাবেয়া বেগম জানান, ছয় বছর আগে তার স্বামী আতিয়ার রহমানকে বাঘে নিয়েছে। বনে মাছ ধরার বরশি ফেলছিলেন। হঠাৎ বাঘের আক্রমন। খবর পেয়ে এলাকাবাসী গিয়ে আতিয়ারের মাথাটা উদ্ধার করতে পেরেছে। স্বামী হারানোর পর থেকে রাবেয়া বেগমের জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। দুই ছেলে দিনমজুরি করে সংসার চালায়।
পাঁচ নম্বর কয়রা গ্রামের আবুল হোসেন গাজী বলেন, শুধু বাঘ নয়, বনের কুমির, সাপসহ সব বন্যপ্রাণীর সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। জীবন চালাতে হলে বনে যেতেই হবে। এলাকার অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ বননির্ভর জীবনযাপন করে। বনে যেতে না পারলে সংসার চলে না। সব বন্যপ্রাণীর আক্রমনের পরও এখানকার মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বন ঘিরেই বেঁচে আছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/শাহ মতিন টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন