ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

সুন্দরবন দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুন্দরবন দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি

রফিকুল ইসলাম মন্টু : বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আরেকটি দিবস, সুন্দরবন দিবস। ২০০২ সাল থেকে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে খুলনাসহ সুন্দরবন সন্নিহিত জেলাগুলোতে। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে তারা সুন্দরবন দিবস হিসেবে পালন  করে থাকে। সুন্দরবনকে বাঁচানোই এই দিবস পালনের প্রধান লক্ষ্য।

উদ্যোক্তাদের আহবান- আসুন, বিশ্বভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসি। সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখি। সেই সঙ্গে সুন্দরবন দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিও তাদের।

দেশের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সুন্দরবন আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি এখন বিশ্বঐতিহ্য। জগদ্বিখ্যাত এ প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী হওয়াতে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আগলে রেখেছে সুন্দরবন। অনেকটা মায়ের কোলে শিশু যেমন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে, তেমনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক বিরাট এলাকা সুন্দরবনকে অবলম্বন করে নিরাপদ রয়েছে। অথচ এই সুন্দরবনের ওপর দিয়ে বারবার ঝড়-ঝাপটা বয়ে যাচ্ছে। সচেতনতার অভাবে এই বিশ্বঐতিহ্য ক্রমেই হুমকির মুখে।

সুন্দরবন দিবস পালনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও সুন্দরবনের উপর কম-বেশি সম্পৃক্ত এবং পরিবেশগত দিক দিয়ে পুরোপুরি নির্ভরশীল। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন প্রবাহের সঙ্গে সুন্দরবন আবর্তিত আবহমানকাল থেকেই। এ অর্থে সুন্দরবনের ভাল-মন্দ, দুঃখ-বেদনা এ অঞ্চলের মানুষকে নাড়া দেয় প্রচন্ডভাবে। এ অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে সুন্দরবনের রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক, নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। এই সুনিবিড় ঘনিষ্ঠতা এবং আত্মার আত্মীয়তার টানেই সুন্দরবনকে আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন মনে করি, যেমনটি একটি নবজাতক করে তার মাকে।

উদ্যোক্তা সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘রূপান্তর’ এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, আমরা যারা সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকার মানুষ, তাদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ২০০৭ ও ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় সাক্ষ্য দেয় যে, সুন্দরবন পরম মাতৃস্নেহে আমাদের আগলে রেখেছিল বলেই আমরা খুবই কম ধ্বংসের শিকার হয়েছি। এ প্রমাণ শুধুই এবারের নয় এটা শতাব্দী থেকে শতাব্দী পর্যন্ত একই ধারায় চলে আসছে। আমরা সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি করলেও সুন্দরবন সব সময় শুধুই দিয়েই গেছে বিনিময়ে সে পায়নি কিছুই। আমরা বলতে চাই যারা বুঝে বা না বুঝে সুন্দরবনের ক্ষতিসাধন করে আসছে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।

সুন্দরবন একাডেমীর নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘সুন্দরবনের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ। একটি মনুষ্যসৃষ্ট, অন্যটি প্রকৃতিসৃষ্ট। এখন মানুষ হিসেবে আমরা যেটি খুব সহজে পারি তা হল মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা দূর করা। আর প্রকৃতির সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলায় সকল মানুষ এক হওয়া। তাই যদি হয়, তাহলে আমাদের প্রথমে যে কাজটি করতে হবে তা হলো-সুন্দরবনের উপর মানুষের যে অনাচার চলছে, তা পুরোপুরি বন্ধ করা। বেআইনী বৃক্ষ নিধন, বন্যপ্রাণী হত্যা, নিরবচ্ছিন্ন মৎস্যসম্পদ আহরণ বন্ধ করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সুন্দরবন শুধুমাত্র পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনই নয়, বিশ্বে সুন্দরবনের মত এত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য আর কোন বনে নেই। এই জন্যই সুন্দরবনকে বলা হয় ‘জীববৈচিত্র্যের জীবন্ত পাঠশালা’। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সুন্দরবন বেঁচে থাকলে সুন্দরবনও বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের, মায়ের মতই পরম আদরে।’

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাঈদ আলী বলেন, ‘শুধুমাত্র বন বিভাগের সামান্য লোকবল ও সীমিত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এ ধ্বংসপ্রয়াস রুখে দেওয়া সম্ভব হয় না। সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকার মানুষেরও এ কাজে সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সুন্দরবন দিবস ব্যাপকভাবে পালন করা হলে মানুষকে সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

মূলত সর্বস্তরের মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর মধ্যদিয়ে সুন্দরবনকে বাঁচানোই দিবস পালনের মূল লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান বরাবরের মত এবারও খুলনায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের মূল ভেন্যু জাতিসংঘ শিশু পার্ক। কর্মসূচিতে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করে। রঙ-তুলিতে ছবি এঁকে তারা সুন্দরবন সম্পর্কে নিজেদের অভিমত প্রকাশ করে।

উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এবার খুলনা মহানগরীর নির্বাচিত ২৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও বর্নাঢ্য সমাবেশ ঘটছে এ দিবসে। বর্ণাাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সুন্দরবন দিবসের  কেন্দ্রীয় কর্মকান্ডে। দিবসের আগের দিন ‘জীববৈচিত্র্যের সুন্দরবন, করবো মোরা সংরক্ষণ’ ধারণাটি রং-তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছে স্কুল পড়ুয়ারা।

সুন্দরবন একাডেমী ও বন বিভাগের যৌথ আয়োজনে এবং কয়েকটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন যেমন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে পরিচালিত ক্রেল প্রকল্প, ওয়াইল্ডটিম, ট্যুর অপারেটর্স এ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন, বাংলাদেশ এনভায়রণমেন্ট এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট সোসাইটি (বেডস), সিসিইসি, রূপান্তর, জেজেএস, দুবলারচর ফিশারমেন গ্রুপ ও খুলনা প্রেসক্লাবের সহায়তায় এবারের সুন্দরবন দিবস পালিত হচ্ছে।

প্রতিবারের মত এবারও খুলনায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচী ছাড়াও বাগেরহাট ও বরগুনা জেলাসহ বিভিন্ন উপজেলা যেমন মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও শ্যামনগরে স্থানীয় বনবিভাগ, প্রেসক্লাব এবং অন্যান্য বেসরকারি সংগঠনসমূহের উদ্যোগে সুন্দরবন দিবসের নানা কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়াও ওয়াইল্ড টীম সুন্দরবনের ৪ রেঞ্জে বন বিভাগের সাথে যৌথভাবে কর্মসূচী পালন করবে। বেডস সারা দেশের ৮০টি স্কুলে সুন্দরবন দিবসের কর্মসূচী পালন করবে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে র‌্যালি, আলোচনা সভা, সেমিনার, কর্মশালা, সংবাদ সম্মেলন ইত্যাদি।

২০০১ সালে খুলনায় অনুষ্ঠিত হয় ১ম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন। ওই সম্মেলনের পরের বছর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় বন বিভাগ ও সুন্দরবন একাডেমীর যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এ উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে-বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুন্দরবন সংলগ্ন সাংবাদিক সমাজ এবং প্রকৃতিপ্রেমী নাগরিকগোষ্ঠী।

সরকারের কাছে সুন্দরবন দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি উদ্যোক্তাদের। তারা বলেছেন, ১৫ বছর ধরে একই দাবিতে সোচ্চার খুলনাসহ আশপাশের জেলাগুলোর বাসিন্দারা। অচিরেই সরকার এ দাবি মেনে নিবে, এমন আশাবাদই সংশ্লিষ্টদের।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়