ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যেদিন হবে ঊর্ধ্বটান, নেত্রে রবে না স্পন্দন

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেদিন হবে ঊর্ধ্বটান, নেত্রে রবে না স্পন্দন

শাহেদ হোসেন : ‘ঊনা ভাতে দুনা বল, অতি ভাতে রসাতল’-  এই খনার বচনের সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও কিন্তু একমত। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতোই বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা অভিধান থেকে ‘দীর্ঘ ঊ’ এর ব্যবহার কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ কারণে বর্তমানে দীর্ঘ ঊ দিয়ে অনধিক ৫০ শব্দ ব্যবহারিক অভিধানে টিকে আছে।

দীর্ঘ ‘ঊ’ স্বরবর্ণমালার ষষ্ঠ বর্ণ। এর উচ্চারণ স্থান ওষ্ঠ। দুই ওষ্ঠ সংকুচিত ও সামনে এগিয়ে মুখবিবর ক্ষুদ্রতম ও জিহ্বা সংকুচিত করে  পূর্ণমাত্রাযুক্ত এই বর্ণটি উচ্চারণ করতে হয়। ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে এর আকার  ‘ূ ’কার হয়। যথা ক + ঊ + কূ। হ্রস্ব ‘উ’ এর এই প্রতিবেশীকে দীর্ঘ ‘উ’ বললেও এর উচ্চারণ কিন্তু দীর্ঘ নয়।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী শত বছর আগে বলেছেন, ‘কথাবার্তার ভাষা আমরা কোন স্বরেরই হ্রস্ব দীর্ঘ ভেদ করি না। খাঁটি বাঙলায় ‘ঈ’ ‘ঊ’ রাখিবার প্রয়োজন আছে কি না সন্দেহ।’ তার এই মতের সাথে মিল রেখে আধুনিক বাংলায় কেবল সংস্কৃত শব্দ ছাড়া আর সব শব্দেই ‘ ঊ’ ব্যবহারকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে।

ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই বলেছেন, ‘বাংলার মূল স্বরধ্বনির ব্যবহারিক বিচারে দীর্ঘ ‘ঈ’ এবং  দীর্ঘ ‘ঊ’ নেই। ‘ইংরেজীতে `sit' শব্দের হ্রস্ব ‘ই’ (i) এবং ‘seat’ শব্দের দীর্ঘ ‘ঈ’(iঃ), কিংবা full শব্দের হ্রস্ব ‘উ’(u) এবং fool শব্দের দীর্ঘ ঊ (uঃ)  জাতীয় ধ্বনি বাংলায় নেই। ধ্বনিতাত্ত্বিক দিক থেকে স্বরের দীর্ঘতা ও হ্রস্বতা বাংলা ভাষায় আভিধানিক পর্যায়ে কোনো শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটায় না, যেমন ঘটায় ইংরেজী কিংবা উর্দু ভাষাতে। তবে আবেগের তারতম্যের ক্ষেত্রে একই শব্দের স্বরধ্বনি ক্ষেত্রবিশেষে হ্রস্ব ও দীর্ঘভাবে উচ্চারিত হতে পারে, তাতে শব্দের মূল অর্থের কোনো পার্থক্য ঘটে না।’

বানান বিভ্রান্তির কারণে ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি কয়েকটি মূলনীতি গ্রহণ করেছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- যদি মূল সংস্কৃত শব্দে ঈ বা ঊ থাকে তবে তদ্ভব বা তৎসদৃশ শব্দে ঈ বা ঊ অথবা বিকল্পে ই বা উ হবে, যথা- ‘কুমীর, পাখী, বাড়ী, শীষ, ঊনিশ, চূন, পূর্ব অথবা ‘কুমির, পাখি, বাড়ি, শিষ, ঊনিশ, চুন, পুব’। কিন্তু কতকগুলো শব্দে কেবল ঈ, কেবল ই অথবা কেবল উ হবে, যথা- ‘নীলা (নীলক), হীরা (হীরক); দিয়াশলাই (দীপশলাকা), খিল (কীল), পানি (পানীয়); চুল (চূল), তাডু (তর্দূ), জুয়া (দ্যূত)।

এরপর বাংলা বানানের অনেক আধুনিকায়ন হয়েছে। আমাদের বাংলা একাডেমি শুধু সংস্কৃত শব্দ ছাড়া আর সব শব্দেই ‘ঊ’ব্যবহার বাতিল করে দিয়েছে। এমনকি যে সমস্ত সংস্কৃত শব্দের বানানে  ‘ঊ’ বা ‘উ’ হয় সেখানে শুধু ‘উ’ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। তবে স্বরস্বন্ধির নিয়মে ‘হ্রস্ব ু’ কার কিন্তু দীর্ঘ ‘ূ’ কার হয়ে যায়। যেমন : কটু + উক্তি = কটূক্তি।

অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে আমরা ‘দূর’ কে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেই। আসলে ‘দূরত্ব’ বোঝালে ‘দূর’ দীর্ঘ ূ কার দিয়েই লিখতে হবে। একইভাবে আমরা ‘অদ্ভুত’ লিখতে গিয়ে ‘অদ্ভূতভাবে’ ভুল করি। আসলে অদ্ভুত ও ভুতুড়ে শব্দের ভুত ছাড়া সব ভূত দীর্ঘ ূ কার দিয়ে লিখতে হবে। যেমন-বশীভূত, ভূতপূর্ব।

দিবসের কোন অংশটুকুকে ‘ঊষাকাল’ বলা হয় তার বর্ণনা দিয়ে খনার বচনে বলা হয়েছে - ‘ঊষার ডাকে পাখি না ছাড়ে বাসা। উড়ে বসে খাবে করি আশা। ফিরে যায় বাসে না পায় দিশা। খনা ডেকে বলে সেই সে ঊষা।’ মানুষের আয়ুষ্কাল সেই ঊষার সময়টুকুর মতোই স্বল্প। অথচ ভোগবিলাসের ‘ঊনকোটি চৌষট্টি’ আয়োজনে ‘ঊর্ধ্বদৃষ্টি’ নিয়ে আমরা ‘ঊর্ধ্বশ্বাসে’ ছুটছি। বহু আগে সীতানাথ বসাক দীর্ঘ ঊ দিয়ে শিখতে বলেছিলেন- ঊর্ধ্ব মুখে পথ চলিও না। তবে এই শিক্ষাটি মুখেই শুধু, বাস্তবে ঊহ্য।

তথ্যসূত্র :

 

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী : শব্দ-কথা

ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব - মুহম্মদ আবদুল হাই

বাঙ্গালা ভাষার অভিধান- শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়