ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দুর্নীতির দায় শুধু পুলিশের, নাকি পুলিশ জনপ্রিয় একটি ইস্যু?

সানোয়ার হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্নীতির দায় শুধু পুলিশের, নাকি পুলিশ জনপ্রিয় একটি ইস্যু?

|| সানোয়ার হোসেন ||
ওসি সাহেব এক লোকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘স্যার, এই যে লোকটাকে দেখছেন, উনি কে জানেন?’

‘নাহ, আমি কি করে জানব?’

‘স্যার, উনি হচ্ছেন এখানকার...উনাকে অনেকেই চেনেন না, চেনে শুধু আমাকে আর ইউএনও স্যারকে।’

‘তাতে সমস্যা কী? সবাইকে চিনতে হবে এমন কোনো কথা আছে?’

‘না স্যার, নাই। সবাইকে চেনার দরকার নাই। তবে তাকে চেনার দরকার আছে। তার দেহটা মানুষের কিন্তু পেটটা কুমিরের। তাই তাকে কুমির হিসেবে সবার চেনার দরকার আছে।’

‘স্যার, এই লোকটা মাসে যা কামায় (অবৈধভাবে) তা এই উপজেলার অন্যসব অফিসার (দুর্নীতিবাজ) মিলেও কামায় না। বদনাম তো হয় খালি থানার ওসি আর দারোগাদের।’

‘এসবের মানে কী?’

‘মানে বুঝলেন না, স্যার? উপরি কামায়। ঘুষ, ঘুষ। প্রতিদিন সকালে একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে অফিসে আসে, আর বিকেলে ব্যাগটা ভরে বাসায় নিয়ে যায়। সবাই ভাবে ব্যাগ ভরে সে হয়তো কাঁচা বাজার নিয়ে যাচ্ছে। আহা, কি করুণ সে দৃশ্য! হা হা হা...।’

ওসি সাহেবের চোখেমুখে ক্রোধ, অপমান আর বিদ্রোহের ছটা লেগে আছে। তিনি তির্যক চোখে ঘৃণা ভরে সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

এবার ওসিকে একটু শান্ত করার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাই নাকি, ওসি সাহেব কী বলেন?’

‘স্যার, কেবল তো চাকরি শুরু করলেন। কিছুদিন যেতে দিন, তখন সব বুঝতে পারবেন, পুলিশ হিসেবে আপনাদের এককভাবে দুর্নীতির এত অপবাদের দায় নিতে কেমন লাগে? সমাজের অন্যান্য পেশার ঘুষখোর লোক আর রাঘববোয়ালদের তো কেউ চোখে দেখে না। সবাই শুধু ঐ থানার দারোগা ব্যাটার পাছায় লেগে থাকে- কত খাইল, কত নিল ইত্যাদি ইত্যাদি। পুলিশের একটা দুর্নীতির খবর ছেপে অনেকেই নোবেল পুরস্কার দাবি করে বসে যত্তসব!’

ওসি সাহেব গোসসা আর কৌতুকের সংমিশ্রণে খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। এভাবেই তিনি অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলেন। আমিও বুঝে নিলাম।

দুই.

এবার আমি প্রতিপক্ষ হিসেবে সেই দুর্নীতিবাজ অফিসারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে ক্যারামবোর্ড খেলছেন। হাতে বার বার পাউডার মেখে ক্যারামের স্ট্রাইকারের গতিপথ পিচ্ছিল করে নিচ্ছেন। একটি স্ট্রাইকও তার মিস হচ্ছে না। তিনি একটা মিস করবেন এই আশায় বাকিরা বুক বেঁধে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মিস হচ্ছে না। ক্যারাম বোর্ডের ৪টি পকেট ভরে যাচ্ছে কালো গুটিতে, ঠিক যেন তার বিকেলের টাকা আর ঘৃণা ভর্তি সেই বাজারের ব্যাগটার মতো। সেদিনই প্রথম উপজেলা অফিসার্স ক্লাবে ঢুকেছিলাম। প্রাণবন্ত সেই ক্লাবে অসংখ্য অফিসারের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেলেও আমার দৃষ্টি শুধু সেই (কুখ্যাত) অফিসারের দিকে। সোফা থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে সেই ক্যারাম বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটি খুব মনোযোগ দিয়ে ক্যারাম খেলছেন। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে হচ্ছিল একটা ধাক্কা মেরে লোকটাকে ফেলে দেই। কিন্তু তখনই মাগরিবের আজান পড়ে গেল। ফলে তিনি খেলার সমাপ্তি টানলেন।

‘আজান দিয়ে দিছে। আজ আর নয়।’

এই বলে তিনি বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় আমার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘আপনারা দু'জন না?’

আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম- ‘এই ব্যাটা আমাকে চেনে কীভাবে?’

‘জ্বি, আমারা দু'জন। এই থানায় আমাদের দু'জন ব্যাচমেইটের এটাচমেণ্ট হয়েছে।’

আমি এ কথা বলা মাত্রই তিনি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন।

‘দেখা হবে।’

এ কথা বলেই তিনি হাতেমাখা পাউডার ঝাড়তে ঝাড়তে বের হয়ে গেলেন। প্রার্থনায় তো আর পাউডার দিয়ে কাজ হয় না, তাই তিনি তা ঝেড়ে নিলেন।

তার চলে যাওয়ার পথের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। অনেক বছর হয়ে গেল, এখনও সেই পথ থেকে ঘৃণার দৃষ্টি সরাতে পারিনি। কারন অসৎ লোকের স্মার্টনেস আমার কাছে দাম্ভিকতার মতো লাগে। হয়তো অসমাপ্ত ঘৃণা নিয়ে সেই পথের দিকে আরও অনেকদিন তাকিয়ে থাকতে হবে।

তিন.

সেদিনের পর তার সাথে আর কোনোদিন দেখা হয়নি। কিন্তু তাদের সন্তানদের সাথে আমাদের সন্তানদের দেখা হয়ে গেছে প্রকৃতির নির্মম নিয়মে। তাদের সন্তানরা স্কুল টিফিন ব্রেকে পুলিশের সন্তানদের বলে, ‘ছি ছি, তোমার বাবা পুলিশ? পুলিশ তো ঘুষ খায়।’

আমাদের সন্তানরা বাড়ি ফিরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাবা, ঘুষ কী?’

একটা দম নিয়ে ছেলেকে ফিরতি প্রশ্ন করি, ‘এসব কী বলছ, বাবা? এগুলো পঁচা কথা।’

‘তাহলে আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে আমাকে একথা বলল কেন যে, পুলিশ ঘুষ খায়?’

কথাটা শুনে বুকের মধ্য দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল শরীর। কৃত্রিম হাসির একটা ভাব নিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কি করে বুঝলে যে ঘুষ খারাপ জিনিস?’

‘ও খারাপভাবে বলেছে তাই বুঝেছি।’

আমি এবার পরাস্ত। কী আর বলব?

‘ওর বাবা কী করেন, জানো?’

না, ছেলে জানে না তার বাবা কী করে। কিন্তু পরে যখন 'ওর' বাবার পেশাটা কৌশলে জানলাম তখন আমার মাথায় আসমান ভেঙ্গে পরলো। এটা তো সেই ক্যারাম খেলোয়াড় অফিসারের পেশা। এই ব্যাটা প্রেতাত্মা হয়ে আবার এখানে এলো কী করে? এরা তাহলে নিজ বাচ্চাদের এই বয়সে ঘুষের উপর ক্লাস নিচ্ছে? ঘুষ কারা খায় সেটাও শেখাচ্ছে? অবাক কান্ড!

এসব দেখে এবং শুনে এখন সেই ওসি সাহেবের কথাগুলো মনে পরে যায়। তার চোখমুখের সেই ক্রোধ, দ্রোহ আর আপমান এখন আমার মুখে প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছে। আয়নাবাজিতে আমিই এখন সেই ওসি। সেই ওসির কষ্টটা এখন আমারই কষ্ট।

অসৎ পিতা পরিবারের সদস্যদের ঘৃণার হাত থেকে বাঁচার জন্য ফেরেশতার মত বাচ্চাদেরও ঘুষ কি তা শেখায়, ঘুষ কারা খায় তা শেখায়। উদ্দেশ্য একটাই- নিজের অপকর্ম ঢাকতে কাছের মানুষজনের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়া।

কিন্তু প্রকৃতির নির্মম পরিহাস হচ্ছে, এভাবেই মনের অজান্তে কুখ্যাত দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতির কালো বীজ তার নিজ সন্তানের মাথায় বপন করে দেয়। ফলে তাদের পাপের ফল আর ঘৃণা তাদের ডিএনএ-তে ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়। এভাবে তারা শিখে নেয়-

‘শুধু পুলিশের দুর্নীতিই অনৈতিক,

আর বাকি সব ন্যায্য কিংবা যৌক্তিক।’

চার.

এদিকে কেউ কেউ শুধুমাত্র পুলিশের দুর্নীতির ছবি ও ভিডিও প্রচার করে, ২/১টা খবর ছেপে, অসংখ্য জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিয়ে চরম দুর্নীতিবাজদের সন্তানদের সামনে দুর্নীতির একপেশে উদাহরণ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে যায়। এসব খবরে খুশি হয় সেই তুখোড় কেরাম খেলোয়াড়রা ও তাদের পরিবারবর্গ। আর এসব শুনে এবং দেখে বিমর্ষ হয় পাউডারবিহীন কেরামের কালো গুটি হাতে নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘর্মাক্ত বোকা পুলিশ। এই পুলিশ পাউডারের ব্যবহার জানে না, তাই পিচ্ছিল পথে নিঃশব্দে কেরামের গুটি পকেট ফেলতে তারা পারঙ্গম হয়ে ওঠেনি। ফলে তারা বার বার হেরে যায় সমাজের অসৎ ক্যারাম খেলার খপ্পরে।

যদিও পুরো খেলাটাই ঘৃণিত এবং অগ্রহণযোগ্য। আমরা ঘৃণা করি এই দুর্নীতি এবং পাউডারবাজী। তবে, ঘৃণার দায়ভারটা ঐকিক নিয়মে সকল পেশার দুর্নীতিবাজদের উপর সমভাবে দেয়াটাই ন্যায্য হবে। কেননা, দুর্নীতি শুধু কতিপয় পুলিশই করে না, অন্যান্য অনেক পেশার অসংখ্য লোকজনও করে বটে। তারপরও শুধু পুলিশই সকল মিডিয়ার ‘হেডলাইন/ব্রেকিং নিউজ’ হয়। এতে ভালো পুলিশও সামাজিক মর্যাদা হারায়, যা একেবারেই অন্যায্য এবং দুঃখজনক। কোন পেশাকে জনপ্রিয় ইস্যু বানিয়ে কুখ্যাতির শীর্ষে তুলে ধরলে, সেই পেশায় মেধাবী এবং মানবিকবোধসম্পন্ন প্রার্থীরা আসতে চায় না। এতে শুধু ঘৃণিত পেশারই ক্ষতি হয় না, বরং সমগ্র সেবা প্রার্থীদের স্বার্থ রক্ষাই বাধাগ্রস্ত হয়।

যারা পাউডারের ব্যবহার জানে তারা কিন্তু আড়ালেই থেকে যায়। অন্ধকারের আড়াল থেকে কালো বিড়াল খুঁজে বের করে খুব কম ক্ষেত্রেই ‘নিউজ’ হতে দেখেছি। কারণ মানুষের প্রচলিত মাইন্ডসেটের কারণে পাউডার ব্যবহারকারীরা নজরে আসে না। এটা হয়তো ইচ্ছাকৃত নয়। এটা অবহেলা, অদক্ষতা, আলসেমি কিংবা পুলিশের নির্লিপ্ততার জন্য হয়ে থাকে। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে তা একপেশে এতে কোনো সন্দেহ নেই । তবে, এটাও এক প্রকারের অন্যায়। দুর্নীতি একটা অন্যায়, এককভাবে কোনো পেশাকে কালার করা আরেকটা অন্যায়।

তাই খুব জানতে ইচ্ছে হয়- জাতীয় দুর্নীতির সবটুকু দায় কি শুধু পুলিশের, নাকি পুলিশ একটি জনপ্রিয় ইস্যু?

আবার পত্রিকার নিউজ গুনে গুনে যারা দুর্নীতির মানদণ্ড বানায় তারা তো অন্ধকারে ‘কাল বিড়াল’ দেখে ‘পুলিশ পুলিশ' বলে চিল্লায়। এই অন্ধদের অন্ধত্ব কখনও ঘুচবে না। কেননা, তাদের মগজে দুর্নীতি বলতে শুধু 'পুলিশ' শব্দটি লেপন করা রয়েছে।

সকল পেশার দুর্নীতি প্রকাশযোগ্য এবং উন্মুক্ত না করতে পারলে পরবর্তী প্রজন্ম হাতে পাউডার মেখে দুর্নীতি করা শিখবে। আর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কলঙ্কিত থেকে যাবে শুধু 'পুলিশ' নামের একট পেশা। বাকী সবাই খালাস!

লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি), কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়