ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শিল্পায়নের স্বার্থেই শ্রম ঝুঁকির ব্যাপারে সচেতনতা জরুরি

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিল্পায়নের স্বার্থেই শ্রম ঝুঁকির ব্যাপারে সচেতনতা জরুরি

প্রতীকী ছবি

হাসান মাহামুদ : শ্রমের মূল্য নিশ্চিত করার বিষয়ে একটি প্রবাদ মোটামুটি বিশ্বের প্রায় সবদেশ এবং সব ধর্মেই প্রচলিত রয়েছে। তা হলো- ‘ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পাওনা শোধ করতে হবে’। কিন্তু এই কথাটি কাগজে-কলমে কিংবা শুধু মে মাসে শ্রমিক দিবসের লিফলেট বা বক্তব্য ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না।

বিষয়টা অনেকটা মৌসুমি হয়ে গেছে। অথচ শ্রমিকরাই একটি দেশের উন্নয়নের প্রাণশক্তি।

স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলাদেশ বা এই অঞ্চল কৃষিপ্রধান। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আমরা শিল্পায়নের দিকে হাঁটছি। যদিও এটি যুগের চাহিদা। আর শিল্পায়নের প্রধান যোগানদাতাদের মধ্যে শ্রমিক অন্যতম প্রয়োজনীয় উপকরণ। আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগুচ্ছি- অন্য কিছু অনুষঙ্গের সঙ্গে শ্রমিকদের কাঁধেই ভর করে।

এরই মধ্যে আগামী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। প্রাক-বাজেট আলোচনার জন্য সময়সূচি প্রকাশ করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বৈদেশিক সাহায্য নির্ণয়ের জন্য সকল মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে এই বাজেট ও এডিপিতে। এমনকি ক’দিন আগে শ্রম আইনও হালনাগাদ করা হয়েছে। এসব কিছুতেই শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত এবং নিরাপত্তার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা এখনো শ্রমিকদের নিরাপত্তা কিংবা অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। এটি আমাদের অবশ্যই ব্যর্থতা।

শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা অনেকেই শুধু শ্রমের মূল্য বিষয়টিকেই সামনে আনি। অথচ শ্রমিকের অধিকার শুধু ন্যায্য পাওনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে বেশকিছু অনুষঙ্গ জড়িত। বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আলোচনার আগে শনিবার শুরু হওয়া ঢাকা অ্যাপারেল সামিটের প্রসঙ্গটি টানা যায়। পোশাক খাতের গুরুত্বপূর্ণ এই সামিটে বিশ্বের পাঁচ শীর্ষস্থানীয় পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান যোগ দিচ্ছে না। তারা গত দুই মাসে বাংলাদেশে ‘ক্রমাবনতিশীল শ্রমাধিকার পরিস্থিতি’র কারণ দেখিয়ে সামিটে যোগদান থেকে বিরত থাকছে। যদিও এই মূল্যায়ন তাদের নিজস্ব। তবুও এটি আমাদের পোশাক খাতের জন্য অবশ্যই একটি নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। এমনকি এর প্রভাবটিও সুদূরপ্রসারী হতে পারে বলে ধারণা করা যায়। আর ট্রেড ইউনিয়নের নানাবিধ অসঙ্গতির কথা বলে বলে বহুল আকাঙ্খিত জিএসপি বিষয়টি বরাবরই আড়াল করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শ্রম খাতের এতো সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আবেদনে সবসময়ই একটি বিষয় চাপা পড়ে যায়। তা হলো নির্মাণকাজের সময় শ্রমিকদের মৃত্যু।

শুক্রবার বিকেলেও রাজধানীর মাজার রোড এলাকায় একটি বহুতল ভবন থেকে পড়ে মোহাম্মদ আলী নামের ২৭ বছরের এক নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন। কিছুদিন আগেই এমন ঘটনা ঘটেছে তেজগাঁওয়ে, তার আগে উত্তরায়। তার কিছুদিন আগে ঘটেছে মালিবাগে। মোটামুটি খোদ রাজধানীতেই কয়েকদিন পরপরই এমন দুর্ঘটনার সংবাদ শোনা যায়। অথচ বিষয়টির প্রতি সরকার কিংবা সংশ্লিষ্টরা নজর দেন না।

গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে লালমাটিয়া নিউ কলোনিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। এসব ভবনের নির্মাণ কাজ চলাকালীন নিউ কলোনির সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে চলাচল করছেন কলোনির বাসিন্দারা। প্রায়ই ইটের টুকরা, খণ্ডিত রড ছিটকে পড়ছে সড়ক বা ভবনের নিচে। এখন পর্যন্ত কেউ হতাহত না হলেও পথচারীদের সাবধানেই চলাচল করতে হচ্ছে। নির্মাণকাজ এখনো চলছে। কথা হচ্ছে, যেখানে ভবনের নিচে কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়, সেখানে নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি তো চিন্তাই করা যাচ্ছে না। এর আগে নবাবপুরে এরকম এক বাড়ির কাজ করতে গিয়ে আলমগীর নামের একজন নিহত হন। এরপর দক্ষিণ বনশ্রী এলাকায় একটি ভবনের পাইলিংয়ের কাজ করার সময় গলায় থাকা চাদর মেশিনে পেঁচিয়ে সোহেল নামের এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

রাজধানীতে এতোগুলো ফ্লাইওভার নির্মিত হলো, এখনো চলছে মগবাজার ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ। এসব ফ্লাইওভারে কখনো শেড ব্যবহার করে কাজ করা হয়নি। একদিকে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলছে আর অন্যদিকে তার নিচ দিয়ে চলাচল করছেন সাধারণ মানুষ। উপরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিকরা। এই বিষয়ে ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এলজিইডি বিভাগ ও নির্মাণ কোম্পানিগুলোকে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে এবং নির্মাণ কাজ চলাকালীন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও লোহার রড উপর থেকে নামানো কিংবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়। কিন্তু সেই নির্দেশনা মানা হয়নি। যার করুন পরিণতি হয় ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ। ফ্লাইওভারের ইস্কাটন অংশের নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার থেকে লোহার রড মাথায় পড়ে রাব্বি আহমেদ ইমন নামের এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তমা কনস্ট্রাকশনস লিমিটেড নামের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ‘এলজি পাওয়ার প্যাক অপারেটর’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন ইমন।

সেই সময়ে ফ্লাইওভারে এলজি রেডিমেড ব্রিজের সমান্তরালের জন্য সেফটি নার্ট খোলার কাজ চলছিলো উপরে। ইমন নিচে কাজ করার সময় উপর থেকে সেফটি নাট পরে মাথায় আঘাত পান। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এর ১০ দিন আগে, ৫ মার্চ নির্মাণ কাজ চলাকালীন ফ্লাইওভারের উপর থেকে ‘ওয়্যার স্টেজিক জ্যাক’ নামের একটি ভারী যন্ত্রাংশ পড়ে যায় এক চলন্ত মোটরসাইকেল আরোহীর ওপর। নুরুল ইসলাম প্রাণে বেঁচে গেলেও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার মোটরসাইকেলটি। সামনের চাকা পুরোপুরি ভেঙে যায় ভারী ওই যন্ত্রাংশ পরে। একই ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজেও। ফ্লাইওভার থেকে লোহার খণ্ড আছড়ে পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক দম্পতির গাড়ির ওপর।

এতো কিছুর পরেও আমরা এখনো ওই ফ্লাইওভারের কাজ কিংবা বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ উন্মুক্তভাবেই চলতে দেখছি। কর্মক্ষেত্রে এটি কখনোই কাম্য নয়। মোট কথা হচ্ছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা কেউ মানছে না। অথচ আইনটি সবদিক দিয়ে ভালো ও পরিবেশবান্ধব। এতে নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা বলা আছে, সাধারণ মানুষদের নিরাপত্তার কথা বলা আছে।

এক সময় দেশে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ছিল না। তখন কিন্তু এতো দুর্ঘটনা ঘটেনি। শ্রমিকরা অনিশ্চিতভাবে মৃত্যুবরণ করেননি। ব্রিটিশ আমলের আইন দিয়ে চলতো সব। কিন্তু জনগণের মধ্যে সচেতনা ছিল, আইন ব্রিটিশ আমলের হলেও আইন মানার প্রবণতা ছিল। কিন্তু এখন দিনদিন আমরা সভ্য হচ্ছি আর আইন মেনে চলা বাদ দিচ্ছি। আইন ভেঙে উদাসীন ভাবে কাজ করছেন সাধারণ জনগণ, পাশাপাশি গৃহায়ন কর্তৃপক্ষও। যার বলি হচ্ছেন অর্থাভাবে কাজ করতে আসা শ্রমিকরা।

অথচ এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। তেমন কোনো খরচ ছাড়া শুধু সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই এসব মৃত্যু প্রতিহত করা সম্ভব।

কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধে যথাযথভাবে শ্রম আইন অনুসরণ করে প্রতিটি কারখানায় বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে সেইফটি কমিটি গঠন করা যেতো। হাইকোর্টের রায় মেনে কোড এনফোর্সমেন্ট অথরিটি গঠন করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড যথাযথ বাস্তবায়ন, আইন বাস্তবায়নে রাজউক এবং কল-কারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন, নির্মাণ কাজ শুরুর আগে নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অনুসরণ, বিনামূল্যে কর্মরত শ্রমিকদের যথাযথ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম পৌঁছানো এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।

সর্বশেষ আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রতিটি জীবনের মূল্য অনেক। তাই আমাদের শ্রমের ঝুঁকির বিষয়টি আমলে নেওয়া উচিত। অন্তত কিছু প্রয়োজনীয় এবং নিবেদিত জীবনের জন্যেও হলেও আইনের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। পাশাপাশি শুধু তদারকি প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে না থেকে ভবনের মালিকদেরও আরো দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়