ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

দ্বীপ রামদাসপুরের অন্তিমকাল!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৪ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্বীপ রামদাসপুরের অন্তিমকাল!

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ভোলার রামদাসপুর ঘুরে : দ্বীপ রামদাসপুরের এখন অন্তিমকাল। শেষ সময়। ভাঙণের ধ্বনি ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর। সেইসঙ্গে বহু মানুষের ছুটে চলা। বাসিন্দারা অনেক আগেই বুঝে নিয়েছেন প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী রামদাসপুর দ্বীপটি আর থাকছে না।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ, একশ বছরের পুরনো বটগাছ, দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাগদা চিংড়ি পল্লী সব গিলেছে ভয়াল মেঘনা। হারিয়ে গেছে অন্তত সাত হাজার বাড়ি, ব্রিটিশ আমলের পুরনো সাইক্লোন শেলটার, তিন শতাধিক একর ফসলি জমি, গাছপালা, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, খেলার মাঠ। ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলো বসেছে পথে। এখন অবশিষ্ট আছে শুধু নি:স্ব মানুষের আহাজারি।

ভোলা জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ইলিশা ফেরিঘাট। এই ঘাট থেকে ট্রলারে ওপারে গেলেই রামদাসপুর। ভর দুপুরে জোয়ারের পানিতে দ্বীপের আশপাশ কেবল ডুবতে শুরু করেছে। জেলেদের কেউ কেউ ছোট নৌকায় নদীতে মাছ ধরছে, কেউবা মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবার কেউ কিছুক্ষণ আগে নদী থেকে এসে অলস দুপুরে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কিছু মানুষ নদী তীরে ভেঙে পড়া গাছ কাটার কাজে ব্যস্ত। অনেকে আবার কাজকর্মহীন। বয়সী কিছু কর্মক্ষম ব্যক্তি রাস্তার ধারে বসে জীবনের হিসাব মেলাচ্ছেন।

ভাঙনের তীরে দাঁড়িয়ে নদীর মাঝে নিজের বাড়িটি দেখানোর চেষ্টা করতে করতে বৃদ্ধ রতন সরদার বলেন, বাড়ি ছিল নদীর মাঝে। ছয়বার স্থান বদল করে এখন কোনমতে এই চরে আছি। জানালেন, অনেক সহায় সম্পদ ছিল তার। প্রচুর পরিমাণে গাছপালা ছিল, ফসলি জমি ছিল। এখন একেবারেই নি:স্ব। নিজে কাজ করতে পারেন না। ছেলেদের রোজগারে বেঁচে আছেন।

 


রামদাসপুরে হাঁটার পথ ধরে চলতে চলতে ঘরবাড়ির চালা, বেড়া, খুঁটিসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র চোখে পড়ে। নদী ভাঙনে বাড়ি হারানোর পর মানুষগুলো এইসব মালামাল এনে স্তুপ করে রেখেছে। ভাঙনের কিনারে একদল মানুষ সারাক্ষণই এই কাজটি করছে। কারণ নদী ভেঙেই চলেছে। সেইসঙ্গে বাড়িও ভাঙছে। আবারও বাড়িহারা হচ্ছে এক একটি পরিবার। এই মানুষগুলোকে দ্বীপের কোন খালি জায়গা বের করে আবারও একটি থাকার ঝুপড়ি বানাতে হচ্ছে। বহতা নদীর মতো মেঘনা তীরের রাসদাসপুরের জীবন এভাবেই বয়ে চলে।

রামদাসপুরে এখন পুরোটাই হাঁটাপথ। রিক্সা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, টেম্পো সবই ছিল এখানে। কিন্তু এখন নেই। দ্বীপের মানুষ হেঁটেই যাতায়াত করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। নদীতে ভাঙতে ভাঙতে অল্প কিছু রাস্তা আছে। এগুলোকে ঠিক রাস্তা বললে ভুল হবে। বলা যায় হাঁটার পথ। ইট বিছানো রাস্তার ইটগুলো খসে খসে পড়ছে। ভেঙে ভেঙে রাস্তা উঁচু নিচু হয়ে গেছে। এই অবশিষ্টটুকু কবে নি:শেষ হয়ে যাবে, সেটাই দেখার অপেক্ষায় এলাকার মানুষ। তখন রামদাসপুরের পথ দিয়ে আর হাঁটার সুযোগ থাকবে না। সেদিন হয়তো আর খুববেশি দূরে নয়।

দ্বীপের বয়সী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই দ্বীপের এখন এক তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট আছে। একই হারে লোকসংখ্যা, ফসলি জমি সবই কমে গেছে। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারটি হাটবাজার, চারটি মসজিদ, একটি বালিকা বিদ্যালয়, একটি সাইক্লোন শেলটার, ১৫ কিলোমিটার রাস্তা, সাত হাজার বাড়ি, দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাগদা চিংড়ি পল্লী, একশ বছরের পুরানো বটগাছ মেঘনা গর্ভে হারিয়ে গেছে। এলাকার বহু মানুষ নোয়াখালী, বরিশাল, চরফ্যাসন, ভোলা সদর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছে।

দ্বীপ ঘুরলে মনে হয়, দুর্যোগের পর মানুষগুলো আবার নতুন করে ঘর বাঁধার আয়োজন করছে। গাছকাটা, মাটিকাটা, ঘর বানানো, রান্নার চুলা ঠিকঠাক করা এখন দ্বীপবাসীর প্রায় প্রতিদিনের কাজ। বেশ কয়েক বছর ধরে এগুলো দ্বীপের নিত্যদিনের কাজে পরিণত হয়েছে। রাতদিন দ্বীপের সবার চোখ থাকে পুর্বে মেঘনা তীরের দিকে। কখন ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে, তীরের মাটিতে কখন বড় একটা ফাঁটল ধরে অনেকখানি ভেঙে যায়, এই চিন্তাই দ্বীপবাসীকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে ফেরে, জানালেন এলাকার মানুষ।

সূত্র বলছে, ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ড রামদাসপুরের আয়তন একেবারেই ছোট হয়ে এসেছে। একসময় চারিদিকে ২২ কিলোমিটার পরিধি থাকলেও এখন আছে মাত্র এক কিলোমিটার। বিদ্যালয় ভবন, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভবন, হাট-বাজার, পাকা রাস্তাসহ অনেক স্থাপনা ছিল এখানে। কিন্তু একে একে সবই এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্কুল সরিয়ে নেওয়াতে বহু ছেলেমেয়ে নতুন করে লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

 


দ্বীপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত শুধুই মানুষের আকুল আহাজারি। এক সময়ের সহায়-সম্পদ আর বাড়িঘরের দৃশ্য তারা আর মনে করতে পারেন না। সেইসব দিনের স্মৃতি তাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। মেঘনার ভাঙনের তীরে এসে কথা হলো মফিজা খাতুন, জায়েদ সরকার, নাগর চৌকিদারসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। রাস্তার মাথায় ভাঙনের কিনারে কয়েকজন নামাজ পড়ছেন। একেবারেই নদীর কিনারে জায়গাটি। দুদিন আগে মসজিদের চালা বেড়া, খুঁটিসহ সব অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু হোগল পাতার কয়েকটি হোগলা বিছানো আছে। এরই ওপরই এখন নামাজ পড়া হয়। দুদিন পর হয়তো এই জায়গাটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

মধ্য রামদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘এখানকার শিক্ষার্থীদের মাত্র ৬০ ভাগ স্কুলে আসে। বাকিরা বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরে। এখানকার মানুষ নি:স্ব হতে হতে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। জীবিকার প্রয়োজনে তাই ছেলেমেয়েদের কাজে যেতে হয়।’

তিনি জানান, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবক্ষেত্রেই এখানে নানা সংকট রয়েছে। ফসলি জমি হারিয়ে নি:স্ব হয়েছে এককালের স্বচ্ছল কৃষকরা। এরা এখন দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে পরিণত হয়েছে। দ্বীপে কোন ফসলি জমি নেই। যেটুকু জমি আছে, তা ব্যবহৃত হয় হাঁটাচলার কাজে।

এই এলাকাটি ভোলা-১ আসনের আওতাভূক্ত। দ্বীপবাসী জানালেন, নির্বাচনে ভোট দিলেও জনপ্রতিনিধিরা দ্বীপবাসীর খোঁজ খুব একটা রাখেন না। নির্বাচনের পর এলাকার লোকজন এমপি কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে খুব একটা দেখেননি বলে অভিযোগ করেন তারা। 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মার্চ ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়