ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শক্তি চট্টোপাধ্যায় : পদ্যের জাদুকর

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২৩ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : পদ্যের জাদুকর

রুহুল আমিন : মনে মনে বহুদূর চলে গেছি – যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়/জন্মেই হাঁটতে হয়/হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে/একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি/পথ তো একটা নয় –তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা/নদীর দু–প্রান্তের মূল/একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূন্য/দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন –দুটো জন্মই লাগে/মনে মনে দুটো জন্মই লাগে। (মনে মনে বহুদূর চলে গেছি)

শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যিনি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। জীবনানন্দ পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা ভাষার এই কবি বিংশ শতাব্দির শেষভাগে বিশেষভাবে পরিচিত ও আলোচিত ছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ২২তম প্রয়াণ দিবস আজ। ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ প্রয়াত হন শক্তিমান এই কবি ।

১৯৩৪ সালের ২৫ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের জয়নগর মজিলপুরে দরিদ্র এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। দারিদ্রের কারণে তিনি পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। স্নাতক অর্ধসমাপ্ত রেখে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়েন। আশ্চর্যজনক হলো, শক্তি চট্টোপাধ্যায় অভাবের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে অন্যকোনো পেশায় না গিয়ে লেখালেখিতে মনোযোগী হন। জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে তিনি উপন্যাস লেখা শুরু করলেন। ‘কুয়োতলা’ নামে তিনি প্রথম ‍উপন্যাস লেখেন। এ ছাড়া ‘স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার’ ছদ্মনামে গল্প লিখতেন তিনি।

এরপর কলেজ জীবনের বন্ধু সমীর রায় চৌধুরীর সঙ্গে পাটনার পাহাড়ি অঞ্চলে আড়াই বছর কাটান।এ সময় কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। কবিতা লিখতে ‍শুরু করেন এবং একজন লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লেখার অভ্যাস গড়ে তোলেন তিনি।

গত শতাব্দির সাড়া জাগানো সাহিত্য আন্দোলন ছিল হাংরি আন্দোলন।বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন উঠতি সাহিত্যিকদের মধ্যে নতুন এক যুগের হাতছানি নিয়ে যেন আসে হাংরি আন্দোলন। যদিও হাংরি আন্দোলন নিয়ে অনেক সমালোচনাও আছে। তারপরও হাংরি আন্দোলন অনেক সাহিত্যিকের জন্মও দিয়েছে বলা যায়। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে মিলে হাংরির আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। তবে ১৯৬৩ সালে সমীর, দেবী ও মলয়ের সঙ্গে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার কারণে তিনি হাংরি ত্যাগ করেন। এই সময় তিনি যোগ দেন হাংরির বিকল্প প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত পশ্চিমবঙ্গের আরেক গুণি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে। হাংরি ছাড়ার আগে শক্তি প্রায় ৫০টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীতে কৃত্তিবাসের কবি সুনীল ও শক্তির নাম তৎকালের সাহিত্যিক মহলে বেশ উচ্চারিত হতে থাকে। এও ঠিক যে সুনীল হাংরি আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং ১৯৬৬ সালে সেই মনোভাবের প্রমাণ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের এক সম্পাদকীয়তে।

ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে/মানুষ ছিলো নরম,/কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।/অন্ধ ছেলে,/বন্ধ ছেলে, জীবন আছে জানলায়/পাথর কেটে পথ বানানো, তাই হয়েছে ব্যর্থ।/মাথায় ক্যারা,/ওদের ফেরা যতোই থাক রপ্ত/নিজের গলা দুহাতে টিপে বরণ করা মৃত্যু/ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে/মানুষ ছিলো নরম, কেটে , ছড়িয়ে দিলে পারতো।/পথের হদিস পথই জানে, মনের কথা মত্ত/মানুষ বড় শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।(ছেলেটা)

তার প্রথম পর্বের কবিতায় (হাংরির সময়ে) নিয়ম শাসিত জীবনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, নিয়ম ভাঙা জীবন যাপনের কথা বলতে দেখা যায়। পরবর্তীতে তার এই উন্মত্ততা স্তিমিত হয়ে আসে ধীরে ধীরে। কবি হিসেবে পরিণতও হতে থাকেন যেন। এই সময় তার কবিতায় বন্ধুত্ব, নারী, মানব সংসর্গ, জীবনের আনন্দ ও ব্যর্থতা বোধ আসতে থাকে। প্রকৃতির প্রতি তীব্র আকর্ষন, নারীর ভালবাসা তার কাব্য জগতে ঘুরপাক খেতে থাকে এই সময়। নিজস্ব ছন্দস্পন্দ ও বলিষ্ঠ ভাষা বাংলা কবিতায় শক্তিকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

তার কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- এ প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (১৯৬২), ধর্মে আছো জিরাফেও আছো  (১৯৬৭), সোনার মাছি খুন করেছি  (১৯৬৮), অন্ধকার নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকার  (১৯৬৮), হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান  (১৯৬৯), চতুর্দশপদী কবিতাবলী  (১৯৭০), পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি  (১৯৭১), প্রভু নষ্ট হয়ে যাই  (১৯৭২), সুখে আছি  (১৯৭৪), ঈশ্বর থাকেন জলে  (১৯৭৫), অস্ত্রের গৌরবহীন একা (১৯৭৫), জ্বলন্ত রুমাল  (১৯৭৫), ছিন্নবিচ্ছিন্ন (১৯৭৫), সুন্দর এখানে একা নয়  (১৯৭৬),কবিতায় তুলো ওড়ে  (১৯৭৬), ভাত নেই পাথর রয়েছে  (১৯৭৯), আঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল  (১৯৮০), প্রচ্ছন্ন স্বদেশ (১৯৮১), যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো  (১৯৮৩), কক্সবাজারে সন্ধ্যা  (১৯৮৫), ও চির - প্রণম্য অগ্নি (১৯৮৫), মিষ্টি কথায়, বিষ্টিতে নয়  (১৯৮৫), সন্ধ্যার সে শান্ত উপহার  (১৯৮৬), এই তো মর্মর মুর্তি (১৯৮৭), বিষের মধ্যে সমস্ত শোক  (১৯৮৮), আমাকে জাগাও  (১৯৮৯), ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে (১৯৯১), জঙ্গলে বিষাদ আছে  (১৯৯৪), বড়োর ছড়া  (১৯৯৪), সেরা ছড়া  (১৯৯৪), টরে টক্কা  (১৯৯৬), কিছু মায়া রয়ে গেল  (১৯৯৭), সকলে প্রত্যেকে একা  (১৯৯৯) ও পদ্যসমগ্র - ১ম থেকে ৭ম খণ্ড।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৭৫ সালে আনন্দ পুরস্কার ও ১৯৮৪ সালে সাহিত্য একাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মার্চ ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়