ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বেলকুচির অসিত ঘোষের সাদা মিষ্টি

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ২৪ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেলকুচির অসিত ঘোষের সাদা মিষ্টি

শাহেদ হোসেন : ঝান্ডু দা'র রসগোল্লার স্বাদ কেমন ছিল তা জানতে হয়তো আপনাকে এপার বাংলা আর ওপার বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের কাছে ছুটতে হবে। তবে প্রকৃত অর্থে রসগোল্লা কী জিনিস আর এর স্বাদ কতোটা অতুলনীয় হতে পারে তা জানতে আপনাকে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার মুকুন্দগাঁতী বাজারের অসিত ঘোষের মিষ্টির দোকানে গেলেই চলবে। রসে ভেজা, গোলগাল, নরম, চামচে কাঁটতেই ভেতরে ছানার দানা এবং না বেশি না কম মিষ্টির অপূর্ব সমন্বয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একজনের মন্তব্যের সূত্র ধরেই খোঁজ মিললো অসিত ঘোষের মিষ্টির দোকানের। তিনি ফেসবুকে সিরাজগঞ্জ নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সিরাজগঞ্জ গেলে অবশ্যই অসিত ঘোষের মিষ্টি খাবেন। খেলেই বুঝবেন কি জিনিস।’ এই ‘জিনিসের’ খোঁজ করতেই শেষ পর্যন্ত যাত্রা করতে হলো সিরাজগঞ্জ।


জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে লুঙ্গির এলাকা বলে পরিচিত বেলকুচির অবস্থান। বেলকুচি বাজারে প্রবেশ করে সোজা সুতাপট্টি। এখানে ২/৩টি সুতার দোকানের পরেই রয়েছে ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, শ্রী অসিত ঘোষ অ্যান্ড ব্রাদার্স (প্রোপ্রাইটর)।

অসিত ঘোষ জানালেন, ১৯৭৮ সালের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। আগে থেকেই মিষ্টির ব্যবসায়ী হওয়ার সুবাদে ওখানকার মিষ্টির দোকাগুলো ঘুরে দেখেছিলেন। এরই মধ্যে এক দোকানের রসগোল্লা খেয়ে ভালো লেগে যায়। দোকানটিতে কয়েকদিন যাতায়াত করে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে রসগোল্লা বানানোর ফর্মুলাটি শিখে নিয়েছিলেন । দেশে ফিরে শুরু করেন সেই ফর্মুলার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রসগোল্লা বানানো। পরবর্তী সময়ে এই রসগোল্লার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশ এলাকায়। স্থানীয়রা অবশ্য একে রসগোল্লা বলে না। তাদের ভাষায় এটি সাদা মিষ্টি।


আলাপচারিতার ফাঁকে প্লেটে করে রসগোল্লা আনালেন অসিত ঘোষ। শোনা কথার প্রমাণ নিতেই এই প্রতিবেদক ও রাইজিংবিডির সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আদিত্য রাসেল খাওয়া শুরু করলেন। সত্যি অতুলনীয়!

রসগোল্লা শেষ না হতেই হাজির করা হলো বেলকুচির বিখ্যাত পানতোয়া। অসিত ঘোষ জানালেন, এটা পুরোটাই ছানা ও ক্ষীর দিয়ে তৈরি এবং ঘিয়ে ভাজা। রঙটা প্রায় গোলাব জামুন নামের মিস্টির মতো, তবে আরেকটু গাঢ়। ভেতরটা হালকা বাদামি। আকারটা আবার গোল নয়, লম্বা এবং তা কালোজামের প্রায় দ্বিগুন । মুখে দিলেই যেন নিমিষে গলে যাচ্ছে। কড়াও নয় আবার কমও নয়, মিষ্টির মাত্রাটা মাঝামাঝি। খাওয়ার পর এক গ্লাস পানি পান করার পর যে ঢেকুর আসবে, তাতে থাকবে খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের ঘ্রাণ।

খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অসিত ঘোষ জানালেন, বাবা মারা যাওয়ার পর সেই ছোটবেলা থেকে মিষ্টি বানানো শুরু। এই ব্যবসায় প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেছে। আগে যমুনা নদীর কাছে দোকান ছিল। সেখানে ভাঙনের পরে ১৯৮০ সালের দিকে চলে আসেন মুকুন্দগাঁতী বাজারে । প্রথমে অবশ্য দোকান ছিল বাসস্ট্যান্ডে । সরকার সেই দোকান ভেঙে দেয়ায় সেখান থেকে বাজারের ভেতরে সুতাপট্টিতে চলে আসা।



দুধের কারণেই মিষ্টির স্বাদের অনেক তারতম্য হয় বলে জানালেন অসিত ঘোষ। তার দোকানের সব মিষ্টি ও দই দেশি গরুর দুধের তৈরি। ফার্মের গরুর দুধের মান খুব একটা ভালো না। গড়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ মন দুধের মিষ্টি বানান আসিত। কাজে সহায়তা করার জন্য তিনজন কারিগরও রাখা হয়েছে। তবে বিশেষ কোনো অর্ডার এলে পুরোটাই নিজের হাতে করেন তিনি। মিষ্টির পাশাপাশি অসিত ঘোষের দইয়েরও সুখ্যাতি রয়েছে বেশ। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ কেজি দই বিক্রি হয় তার দোকানে।

অসিত ঘোষ জানালেন, দোকানের দই-মিষ্টির দাম অন্যদের তুলনায় একটু বেশি হওয়ায় বিক্রির হার একটু কম। আর দাম বেশির একটাই কারণ হচ্ছে খাঁটি দুধ ও ছানা। এখানে সাদা মিষ্টি বিক্রি হয় ২৫০ টাকা কেজিতে। অথচ বাজারের অনেক দোকানেই মিষ্টি বিক্রি হয় দেড়শ টাকা দরে। তবে দাম বেশি হলেও দোকানের মিষ্টি সচরাচর বাসী হয় না । কখনো হয়ে গেলে সেটা ফেলে দেয়া হয়। আর যদি তখনো খাওয়ার মতো থাকে তাহলে নিতান্তই কম দামে দরিদ্র ক্রেতাদের দিয়ে দেয়া হয়।

ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের দুই দোকান পরেই সুতা ব্যবসায়ী হাজি রফিকুল ইসলামের দোকান। বাজারের সেরা মিষ্টির দোকান কোনটি জানতে চাইলে নির্দ্বিধায় তার উত্তর ‘অসিত ঘোষের।’



তিনি বলেন, ‘আমাগো বেলকুচিতে পূর্বানী ও রহমত গ্রুপের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে। তারা সব সময় অসিত ঘোষের কাছ থেকে মিষ্টি নেয়। আমার ছেলে-মেয়েরা এই দোকানের মিষ্টি ছাড়া অন্য দোকানের মিষ্টি খায় না। গতবার হালখাতার সময় কারা যেন বাসায় মিষ্টি দিয়ে গিয়েছিল। ওগুলা কয়েক দিন ঘরেই পড়ে ছিল, কেউ ছুঁইয়া দেখে নাই।’

শুধু হাজি রফিকই নন, আশেপাশের কয়েকজন দোকানি জানালেন, এই বাজারে ১০/১২টা মিষ্টির দোকান আছে। কিন্তু অসিত ঘোষের মতো মিষ্টি কেউ বানাতে পারে না।

ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যা আর এক পুত্রের জনক অসিত ঘোষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, আর ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ছেলেকে এই ব্যবসায় আনবেন? জানতে চাইলে এই মিষ্টি ব্যবসায়ী বললেন, ‘ভাই-বোনদের নিয়ে এখনো যৌথ পরিবারে আছি। এতোদিন ধরে ব্যবসা করি। মইরা গেলে আমার ঐতিহ্য ধইরা রাখতে হইব না? ছেলে পড়াশোনা শেষ করুক। আপনেই এই ব্যবসায় আয়া পরব।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মার্চ ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়