ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কঙ্গোয় বেলজিয়ামের গণহত্যা রয়ে যায় অন্তরালে

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ১১ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কঙ্গোয় বেলজিয়ামের গণহত্যা রয়ে যায় অন্তরালে

কেটে নেওয়া হয়েছে এদের হাত

শাহেদ হোসেন : ‘মানুষখেকো’, ‘শিক্ষার আলো বঞ্চিত’ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দিয়ে সভ্য করার ব্রত নিয়ে আফ্রিকায় প্রবেশ করেছিল ‘শিক্ষিত ইউরোপীয়রা।’ আফ্রিকার সেই ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েই শেষ পর্যন্ত দাঁড় করানো হয়েছে আজকের ইউরোপের অনেক দেশের উন্নত অর্থনীতির ভীত । এসব শোষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় ব্রিটেন ও জার্মানির নাম। তবে আফ্রিকানদের ওপর উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের নৃশংস নির্যাতনের কথা কৌশলেই এড়িয়ে যাওয়া হয়। কঙ্গোর বাসিন্দাদের ওপর বেলজিয়ামের প্রথম সাংবিধানিক রাজা লিওপল্ড যে নির্যাতন চালিয়েছেন তার জন্য ঐতিহাসিকরা পর্যন্ত তাকে ‘বুচার অব কঙ্গো’ বা কঙ্গোর কসাই হিসেবে আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন।

১৮৬৫ সালে সিংহাসনে আরোহনের আগেই আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য বেলজিয়ামের রাজনীতিবিদদের মধ্যে লবিং শুরু করেন লিওপল্ড। ব্রিটেন, জার্মানি ও স্পেন ওই সময় আফ্রিকা দূর প্রাচ্যে উপনিবেশ স্থাপন করে ফেলেছে। লিওপল্ডের দাবি, বেলজিয়াম উপনিবেশ স্থাপন করতে না পারলে ইউরোপে তার মর্যাদা থাকবে না। ওই বছরেরই ১৭ ডিসেম্বর সিংহাসনে আরোহন করেন লিওপল্ড। এরপর আফ্রিকায় গোয়েন্দাগিরি ও উপনিবেশ স্থাপনের জন্য জায়গা বাছাইয়ে পর্যটক ও পাদ্রী হেনরি এস স্ট্যানলিকে ব্যবহার করেন তিনি। আফ্রিকার মানুষদের ‘শিক্ষিত’ করার ব্রত নিয়ে লিওপল্ড ইন্টারন্যাশনাল আফ্রিকান সোসাইটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের আড়ালে পুরোদস্তুর দাস ব্যবসা চালিয়ে যেতেন লিওপল্ড। ১৮৭৯ সালে কঙ্গোর বিশাল এলাকা নিজের বলে দাবি করেন তিনি।

লিওপল্ড কঙ্গোতে নিজের উপনিবেশ বিস্তার করতে যাচ্ছেন, সেই পরিকল্পনা ফরাসিরা টের পেয়ে যায়। এরপরই ফ্রান্স তার নৌবাহিনী মধ্য আফ্রিকায় পাঠায় এবং কঙ্গোর পশ্চিম উপকূল দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে আফ্রিকার ভাগ নিয়ে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে পিঠার ভাগ নিয়ে লড়াই বন্ধে ১৮৮৪ সালে বার্লিনে সম্মেলনের ডাক দেন জার্মান চ্যান্সেলর বিসমার্ক। সম্মেলনে রাজা লিওপল্ড পেলেন আপার কঙ্গোর প্রায় ২৬ লাখ বর্গকিলোমিটার জায়গা। আর ফ্রান্স পেল সমুদ্র তীরের কিছু অংশ ।

 


মেয়ের কাটা হাত-পা সামনে নিয়ে স্তব্ধ বাবা

 

প্রথম দিকে যেমনটা আশা করেছিলেন কঙ্গো থেকে ততোটা মুনাফা পেতেন না লিওপোল্ড। তার বাণিজ্য তখন সীমিত ছিল হাতির দাঁত ও দাস বিক্রির ওপর। তবে কয়েক বছরের মাথায় রাবারের ব্যবহার জেনে যায় মানুষ। রাবারের সঙ্গে কার্বন মেশালে সেটা যে প্রায় অক্ষয় বস্তুতে পরিণত হয় সেটা আবিষ্কার হয়েছে ওই সময়। গাড়ির শক্ত চাকা সেই কালো বস্তুতে মুড়ে দিলে চলাফেরা হয় মসৃন। এ কারণে টায়ারের তখন ব্যাপক চাহিদা। কঙ্গোর প্রাকৃতিক রাবার তখন লিওপল্ডের কাছে হয়ে ওঠে সোনার খনি।  তিনি কঙ্গোর মানুষদের দিয়েই কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন শুরু করেন। কঙ্গোতে তার নিজস্ব বাহিনীর নাম ছিল ফোর্স পাবলিক।

লিওপল্ড রবার সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বেলজিয়ামের ব্যবসায়ীদের। রাবার সংগ্রহের জন্য তারা স্থানীদের ওপর লোমহর্ষক ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাতো । রাবার সংগ্রহকারীদেরকে রাবার গাছের জন্য জঙ্গলে ঢোকার সময় গাছের পাতায় ও লতায় লম্ব্বা দা দিয়ে কোপ দিতে হতো। এতে অনেক সময় তরল রাবার ছিটকে এসে তাদের গায়ে আটকে যেত। লিওপল্ডের সেনারা এসব রবার অপচয় করতে রাজী ছিল না। তারা পরে দা কিংবা ছুরি দিয়ে তাদের শরীর থেকে এই রাবার উঠিয়ে নিতো। শরীর থেকে এভাবে রাবার উঠানোর সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পশমসহ চামড়া উঠে আসত। চামড়া উঠে পড়ায় এই মানুষগুলোর গগনবিদারি চিৎকার গায়েই মাখতো না লিওপল্ডের সেনারা।

রাজা লিওপল্ডের নির্দেশে ফোর্স পাবলিকের অফিসাররা জনপ্রতি আইভরি বা হাতির দাঁত ও রাবার সংগ্রহের কোটা ধার্য করে দিত। নির্দিষ্ট পরিমাণ আইভরি বা রাবার সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এই দণ্ড কার্যকর করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর গুলি অপচয় হয়েছে কি-না তার প্রমাণ হিসেবে প্রত্যেকটি গুলির বিপরীতে মানুষের একটি করে কাটা কব্জি জমা দিতে হতো। তবে সেনাবাহিনীর অফিসারদের দয়া হলে কুমিরের চামড়ার চাবুক খেয়েই অনেকে বেঁচে যেত।

লিওপল্ড বাহিনীর নির্যাতনের ছোট্ট একটি নমুনা এখানে তুলে ধরা হলো। ১৯০৪ সালের ঘটনা এটি। রাবার চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরন করতে না পারায় এক কৃষ্ণাঙ্গের পাঁচ বছরের মেয়ের হাত-পা কেটে খুন করে লিওপল্ড বাহিনী। এরপর তার স্ত্রীকে খুন করা হয়। পরে ওই চাষীর সামনে তার মেয়ের কাটা হাত-পা রেখে দেওয়া হয় শাস্তি হিসেবে।

 


শেকলবন্দী কঙ্গোর বাসিন্দাদের কয়েকজন

 

কঙ্গোবাসীর সঙ্গে কী ধরণের আচরণ করতে হবে অনেক সময় লিওপল্ড নিজেই চিঠি লিখে পাদ্রীদের নির্দেশ দিতেন। ১৮৮৩ সালে কঙ্গোতে কর্মরত ঔপনিবেশিক মিশনারিদের কাছে লেখা চিঠিতে লিওপল্ড স্থানীয় তরুণদের খ্রিষ্টান ধর্মে দিক্ষীত করার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা সরাসরি তরুণদের ধর্মান্তরিত করার ওপর জোর দেবেন। তারা যখন দেখবে বাবা-মায়ের দেয়া শিক্ষা আর যাজকদের দেয়া শিক্ষার মধ্যে অমিল রয়েছে তখন আর তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে না। শিশুরা যাতে মিশনারিদের কথা মেনে চলে সেজন্য তাদেরকে সেই শিক্ষা দেবেন।’

তিনি লিখেছেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গদের সবসময় ধর্মান্তরিত করতে চাবুক ব্যবহার করুন। তারা যাতে বন্ধনহীন হয়ে কাজ করতে পারে সেজন্য তাদের স্ত্রীদের নয় মাস গির্জার কাছে রাখার কথা বলুন। যখনই আপনারা তাদের গ্রামের যাবেন তখন আপনাদের ডিম, মুরগি, ছাগল দিতে তাদেরকে বাধ্য করুন। কৃষ্ণাঙ্গরা যাতে ধনী হতে না পারে সেটি নিশ্চিত করুন।’

লিওপল্ডের বাহিনীর নির্যাতনে কঙ্গোর ঠিক কতো লোক মারা গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত যে, এ সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ লাখের নিচে নয়। তবে মার্কিন লেখক অ্যাডাম হসচাইল্ড তার কিং লিওপল্ড’স ঘোস্ট বইতে দাবি করেছেন, ওই সময় সরকারি বিভিন্ন নথির মাধ্যমে জানা গেছে, লিওপল্ডের নির্যাতনে কঙ্গোর অর্ধেক বাসিন্দা মারা গেছে। আর ১৯২৪ সালে বেলজিয়ান সরকার পরিচালিত প্রথম আদম শুমারিতে দেখা গেছে, তখন কঙ্গোর জনসংখ্যা ছিল এক কোটি। অর্থাৎ এই হিসেব করলে, লিওপল্ডের নির্যাতনে নিহত মানুষের সংখ্যা এক কোটি!

১৮৮৯ সালে আমেরিকার রাজনীতিবিদ, উকিল, সাংবাদিক ও আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাসের লেখক জর্জ ওয়াশিংটন উইলিয়ামস কঙ্গোতে নিজের চোখে লিওপল্ড বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র দেখেন। ১৮৯০ সালের ১৯ জুলাই তিনি লিওপল্ডের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লেখেন। এতে তিনি লিওপল্ডকে বলেন,  রাজার নামে সেনারা কঙ্গোবাসীর ওপর বর্বর অত্যাচার করছে। এর ফলে তার সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। তাই তিনি যেন অবিলম্বে এসব বন্ধ করেন। জর্জ ওয়াশিংটন উইলিয়ামসের লেখা এই চিঠিটিই ছিল কঙ্গোতে লিওপল্ড বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ। তিনি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কঙ্গোতে ঘটা এই বর্বর অত্যাচারের চিত্র ফাঁস করে দেন।

 


রাজা লিওপোল্ড

 

১৯০৬ সালে অধিকারকর্মী ও লেখক ই ডি মোরেলের লেখা ‘রেড রাবার’ বইটি প্রকাশের পর কঙ্গোর বিষয়টি আবারও আলোচনায় চলে আসে। ব্যাপক সমালোচনার পর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের চাপে ১৯০৮ সালে রাজার হাত থেকে কঙ্গোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বেলজিয়াম সরকার। বিচারতো দূরের কথা, বরঞ্চ কঙ্গো ছেড়ে দেওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে লিওপল্ডকে দেওয়া হয় পাঁচ কোটি ফ্রাঁ।

আর্মেনিয়ার গণহত্যা কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধন নিয়ে যতোটা আলোচনা হয়, তার সিকিভাগও হয় না কঙ্গোতে পরিচালিত বেলজিয়ামের রাজার গণহত্যা নিয়ে। বরং উপনেবিশবাদীরা সুকৌশলে বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন বারবার। আজও কঙ্গোর কাছে বর্বর নির্যাতনের জন্য ক্ষমা চায়নি বেলজিয়াম।

তথ্যসূত্র :
The Butcher of Congo : Baffour Ankomah
History of the Belgian Congo: Imperialism, Genocide & Atrocities
King Leopold II: The Forgotten Genocide in the Congo
Murder for Money: Congo, 1st Genocide of the 20th Century
By Bertrand Russell
উইকিপিডিয়া



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ এপ্রিল ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়