ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভাইয়ের লাশ দেখে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ হন নাজির

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০০, ১৬ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাইয়ের লাশ দেখে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ হন নাজির

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা : ১৯৭১ সালের মার্চ মাস । চারিদিকে যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করেছে। চলছে রাজাকার আলবদরের দফায় দফায় গোপন বৈঠক।

মুক্তিকামী জনতাও নিচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি। তখন ২২ বছরের টগবগে যুবক নাজির মোল্লাও মুক্তিকামী জনতার আহ্বানে সাড়া দেন।

তিনি তখন বাস করতেন যশোর জেলার কালিয়ার ডুমুরিয়া গ্রামে। বাবা আফতাব উদ্দিন মোল্লা ও মা তোরা বিবির দুই সন্তানের সর্ব কনিষ্ঠ তিনি।

নাজির মোল্লা বর্তমানে নগরীর ইসলামপুর সড়কের দোলখোলা এলাকায় বাস করছেন। নিরাপত্তা কর্মীর কাজ করছেন।

মুক্তিযোদ্ধা নাজির মোল্লা বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তার মামাতো ভাই জহুর শেখ শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পথে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিগলিয়ায় গোপিনাথপুর পোলের কাছে তাকে হত্যা করে রাজাকার খলিল, ওয়াদুদ, শামসু ভুইয়াসহ অনেকে। মামাতো ভাইয়ের লাশ দেখেই মূলত তিনি যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত হন।

ভাই হারানোর পর তিনি গ্রাম থেকে নুর জামাল, কবির জোমাদ্দার, রতন, জাকিরসহ অনেক লোক জড়ো করে তাদেরকে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারত যান। তিন মাস ট্রেনিং শেষে অস্ত্র গোলাবারুদসহ সাড়ে ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দেশে ফেরেন। ট্রেনিংয়ের সময় তিনি মেশিন গান ও রকেট লাঞ্চারসহ নানা ধরনের অস্ত্র চালানো রপ্ত করেন।

দেশে এসে তিনি কালিয়ার খইলশাখালি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগদান করেন। তিনি প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন কালিবাড়ি নকশাল ক্যাম্পে। সেখানকার চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা হামুকে  হত্যা করা হলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে নকশালদের খড়িয়াল নদীর ওপারে পাক সেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে নকশাল বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ সময় রাজাকারদের জল্লাদ ফায়েককে তারা হত্যা করে। এরপরে তিনি যুদ্ধে অংশ নেন রাজাকারদের কালিয়া হাইস্কুল ক্যাম্পে। সেখানে গভীর রাতে তিনিসহ সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা হাইস্কুল ক্যাম্পে আক্রমণ ও ঘেরাও করে রাখেন। দুপক্ষের মধ্যে তুমুল গুলি বিনিময় হয়। রাজাকার ক্যাম্প ঘেরাও করে রাখায় তাদের খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়।

এ সময় মুক্তিযোদ্ধা নাজির মোল্লা তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে চিরকুট পাঠান। চিরকুট পেয়ে তারা আত্মসমর্পণ না করে উল্টো গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এভাবে চারদিন টানা তুমুল সংঘর্ষের পর চতুর্থ দিনে আত্মসর্মপণ করে রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। যুদ্ধকালীন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ করে গ্রামবাসী।

এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ২০ থেকে ২৫ জন শহীদ হন। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার মিলে ৮০০জন বন্দি হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।

নাজির মোল্লা যুদ্ধের পর স্বেচ্ছাসেবক কমিটিতে কিছুদিন কাজ করেন। এ জন্য তিনি কালিয়ার স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অর্থ পেতেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অগ্রণী ব্যাংকে যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালে ব্যাংকের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনের কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

১৯৮১ সালে তিনি আনসারে যোগদান করেন। সেখানে তিনি দেড় বছর কাজ করার পর ১৯৮৩ সালে বাড়িতে চলে আসেন। ১৯৮৫ সালে তিনি খুলনা-ঢাকা রূটের নৌযানের নিরাপত্তা বিভাগে যোগদান করেন। একই সঙ্গে তিনি খুলনা রেলওয়ে থানায় আনসারের চাকরি করতেন। ১৯৮৯ সালে তিনি লঞ্চের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর তিনি নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি শীববাড়ি মোড়ে ডা. আব্দুল কাদেরের বাড়িতে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার মুক্তি বার্তা নম্বর ০৪০৭০৩০৫৪৮, গেজেট নম্বর ৮০১ । তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক। বড় ছেলে আবুল বাশার ডিগ্রি পাস করে ব্যবসা করছে। ছোট ছেলে স্বর্ণের দোকানে কর্মরত রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা নাজির মোল্লা বলেন, জীবন বাজি রেখে যে মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করেছেন- সেই দেশে তার বসবাসের কোনো ভূমি নেই। থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাসায়। তিনি সরকারের কাছে বাসযোগ্য জমির আবেদন করেন।




রাইজিংবিডি/খুলনা/১৬ এপ্রিল ২০১৭/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়