ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

কুয়াকাটায় সৈকত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ২৫ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কুয়াকাটায় সৈকত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

রফিকুল ইসলাম মন্টু, পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা ঘুরে : সমুদ্রের নোনা জলের ঝাপটায় অপরূপ সৌন্দর্য্য নিয়ে জেগে আছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। বিকাশের ধারায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই পর্যটন কেন্দ্র। রয়েছে অনেক সম্ভাবনা, অনেক স্বপ্ন। এখানকার সৈকতের দীর্ঘ বেলাভূমিতে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আকর্ষণ দেশজোড়া। দলে দলে পর্যটকেরা ছুটে আসেন এই বেলাভূমিতে। তবুও কোথায় যেন থেকে যায় একের পর এক সংকট। জটিলতার অবসান হয়না কিছুতেই। সংকটের ভেতর দিয়েই ডানা মেলছে কুয়াকাটা। তারপরও প্রতিটি নতুন ভোরে নতুন আশাবাদ।



এককালে জঙ্গলে পূর্ণ ভয়ের জনপদ কুয়াকাটা এখন আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে রয়েছে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত। এই সৈকত প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হলেও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। সৈকত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। ভাঙছে তীর। ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সৈকত জুড়ে। সৈকতে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট মাছ আর শুটকি পল্লীর উৎকট গন্ধ এখন পর্যটকদের সবচেয়ে বিরক্তির কারণ। এ যেন অভিভাবকহীন এক পর্যটন। সম্ভাবনা বিকাশে নেই কোন ধরণের পদক্ষেপ।

পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম আকাশে তেজ কমে যাওয়া সূর্যটা সৈকতের প্রান্ত জুড়ে ছড়িয়ে দেয় রক্তবর্ণ আভা। ভেজা বালুতে পর্যটকদের পায়ের ছাপ আর ছড়িয়ে থাকা শামুক-ঝিনুক যেন এক ভিন্নমাত্রা যোগ করে। জীবিকার প্রয়োজনে সমুদ্রগামী জেলেরা তখন হয়তো ঘরে ফেরে; কিন্তু গোধুলির আবছা আলো পর্যটকদের তখন নিয়ে যায় ভিন্ন আবেশে। উষালগ্নে সৈকতে আরেক হই-হুল্লোড় ছড়িয়ে পড়ে। ভোরে সমুদ্র স্নানটা অনেকের কাছে যেন পূণ্যতা লাভের শামিল। সমুদ্রের পানিতে সব ধুয়ে মুছে মানুষগুলো ফিরে যায় আপন ঠিকানায়।

এতটা উৎসবমুখর পরিবেশের মাঝেও শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনার কারণে পর্যটকদের চাহিদা পুরোপুরি মেটাতে পারছে না কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। সৈকতের বেলাভূমিতে পচা মাছের উৎকট গন্ধে পর্যটকরা নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করতে পারছেন না। আছে আরও অনেক সমস্যা। এতটুকু নির্মল বাতাসে স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলতে আসা মানুষগুলো যেন আরেক অস্বস্থির মধ্যে ডুবে যান এখানে এসে।

পড়ন্ত বেলায় সৈকতেই আলাপ রাজধানী ঢাকা থেকে আসা পর্যটক আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। বললেন, এখানে এসে আমরা নির্বিঘ্নে বেড়াতে পারছি না। সৈকতে উঠানামার ভালো ব্যবস্থা নেই। চারিদিকে পড়ে আছে ময়লা আবর্জনা। মাছের গন্ধ তো আছেই। দেখে মনে হয় কুয়াকাটা যেন অভিভাবকহীন। অথচ এই পর্যটন কেন্দ্রের রয়েছে অনেক সম্ভাবনা। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সে সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।


সরেজমিন ঘুরে কুয়াকাটা সৈকতের চরম অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে। সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র দু’শ গজ পশ্চিমে কারেন্ট জালে শিকার করা হচ্ছে মাছ। জালে আটকা পড়ছে মনকে মন মাছ। সেই মাছসহ জাল আর ডিঙি নৌকা উঠে যায় সৈকতে। নারী-পুরুষ আর শিশুরা মিলে জাল থেকে মাছ ছাড়ানোর কাজে লেগে যায়। কিন্তু জালে বেশি পেচিয়ে থাকা মাছগুলো আর ছড়ানো হয় না। ওই মাছ জালসহ থেকে যায় সৈকতে। জালের মাছগুলো কাক-কুকুড়ের খাবারে পরিণত হয়। অন্যদিকে ছড়ায় গন্ধ। পর্যটকেরা চাইলেও এর আশপাশে বেড়াতে পারেন না।

শুধু মাছ নয়, জেলেদের জালে আটকা পড়া নানা জলজ প্রাণীও সমুদ্র সৈকতেই ফেলে রাখা হচ্ছে। এছাড়া সমুদ্রের ঢেউয়ে কিছু জলজ প্রাণী সৈকতে উঠে যাচ্ছে। এগুলো অপসারণের কোন ধরণের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ফলে এগুলো পর্যটকদের নির্বিঘ্নে বেড়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এছাড়া কুয়াকাটায় নিত্য ব্যবহার্য্য বর্জ্যের একটি বড় অংশ সৈকতের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা নির্মিত হলেও কুয়াকাটার কোন প্রতীকী স্থাপনা এখনও এখানে পড়ে ওঠেনি। এমন কোন স্থাপনা নেই, যা দেখলে বোঝা যাবে এটা কুয়াকাটা। সৈকতের কোন গাইডলাইন বোর্ডও স্থাপিত হয়নি আজ পর্যন্ত। বেড়িবাঁধ থেকে সৈকতের দিকে চলে গেছে পিচঢালা সড়ক। কিন্তু সৈকত প্রান্তে এ সড়কটি ভাঙণের শিকার। সৈকতে উঠানামার জন্য পাশ দিয়ে পথ বানানো হয়েছে। আলো কমে গেলে এ পথে উঠানামা অত্যন্ত কষ্টকর। 

অভিযোগ রয়েছে, কুয়াকাটা সৈকতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি কিংবা কুয়াকাটা পৌর কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যা নিরসনের কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে বহু আকাংখা নিয়ে এখানে বেড়াতে আসা পর্যটক-দর্শনার্থীর ভোগান্তির শেষ নেই।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পরিচ্ছন্ন সৈকত হিসাবে কুয়াকাটার আলাদা সুনাম রয়েছে। কিন্তু সে সুনাম হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকারি প্রশাসন, পৌর পরিষদ কিংবা কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির কোন ভূমিকা নেই। ইতোপূর্বে ট্যুরিষ্ট বোট মালিক সমিতি স্থানীয় লোকজন নিয়ে সৈকতে ফেলা ডাবের খোসা, বিভিন্ন ধরণের পলিথিন অপসারণের উদ্যোগ নিলেও তা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।

কুয়াকাটা পৌর প্রশাসক ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, অবশ্যই এসব যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব কুয়াকাটা পর্যটন হলিডে হোমস এন্ড মোটেলস-এর ম্যানেজার মো. আজহারুল ইসলামের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারলেন না। এ বিষয়ে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে তারা উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন।

এদিকে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় যে যেভাবে পারছে দখল নিচ্ছে। কেউ ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে, কেউবা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়। নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্য থামে না। আর অবৈধ দখলের কারণে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সৌন্দর্য্য নষ্ট হচ্ছে। অপরিকল্পিত বাড়িঘর উঠে এখানে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কুয়াকাটার বেড়িবাঁধের বাইরে সৈকতপাড় পর্যন্ত সড়কটির দুইদিকে ও আশপাশে শতাধিক স্থাপনা রয়েছে। চিহ্নিত একটি চক্র ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে এসব স্থাপনা তুলেছে। সৈকত এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরের সাড়ে চার সহস্রাধিক একর জমি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এই অবৈধ স্থাপনাগুলোর কারণে ঝড়-জলেচ্ছ্বাসকালে জীবনহানির শঙ্কায় থাকছে পর্যটকসহ হাজারো মানুষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, অবৈধ দখল কুয়াকাটার অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র বিকাশের পথে এটি বড় বাঁধা। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের আদেশ রয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে, এমনকি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সীমানাও নির্ধারণ করা হয়েছে। তারপরও কুয়াকাটাকে দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না।


সূত্র বলছে, উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে বিভিন্ন কৌশলে ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে কুয়াকাটায় দখলদারিত্ব অব্যাহত রয়েছে। বার বার উচ্ছেদ হলেও নতুন করে আবার দখল চলে। ২০১১ সালের ২ জুন পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে সব ধরনের স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় দু’শতাধিক স্থাপনা ভেঙ্গে দেয় পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন। দীর্ঘদিন ধরে স্থাপনা তোলার কাজ বন্ধ থাকে। ওই সময় কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা করতে দুটি রুলও জারি করা হয়।

মহিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কুয়াকাটা বেড়িবাধেঁর বাইরে পর্যটন মার্কেটে লতাচাপলী মৌজার ৭৪৩ খতিয়ানের ৭৪৭৫ নং দাগের মাত্র ২৪ শতাংশ জমি রেকর্ডীয় থাকলেও প্রায় দুই একর সরকারি খাসজমি দখল করে মার্কেট ও আবাসিক হোটেল করা হয়েছে।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বেলাভূমি দখল করে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা তোলা হয়। কোথাও আবার কাঁটাতারের বেড়াও দেয়া হয়। অন্যদিকে কুয়াকাটা সৈকতের শেষপ্রান্তে কাউয়ারচর বেলাভূমে একাধিক হাউজিং কোম্পানি শত শত সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। বিভিন্ন সময় এসব সচিত্র প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও জেলা প্রশাসন নামেমাত্র দখলদার উচ্ছেদের নামে কখনও নোটিশ, কখনও নামমাত্র উচ্ছেদ অভিযান চালায়।

অবৈধ স্থাপনা প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থাপনার মালিক বলেন, এমনিতেই সাগরে সব ভেঙ্গে যাচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই সৈকত তীরে কোনভাবে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ এপ্রিল ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়