ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ভারতের একটি ভুলে যাওয়া গণহত্যা

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২৮ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভারতের একটি ভুলে যাওয়া গণহত্যা

শাহেদ হোসেন : শক্তির দাপটে অনেক ঐতিহাসিক সত্য ধামাচাপা পড়ে যায়, আবার অনেক তুচ্ছ বিষয়ও ইতিহাসের পাতায় বড় করে দেখানো হয়। ইতিহাসের সঙ্গে লুকোছাপা খেলতে মূলত: তিনটি শক্তির প্রয়োজন হয়- রাজনৈতিক , গণমাধ্যম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ভারত তিনটি শক্তিই অর্জন করেছে। সেই শক্তির বদৌলতেই ইতিহাসের চোরাগলিতে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশ বিভাগের মাত্র এক বছরের মাথায় হায়দারাবাদে চালানো ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গণহত্যার কাহিনী।

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজের অধীনে রাজা শাসিত ৫৬৬টি রাজ্য ছিল। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল হায়দারাবাদ। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় রাজা শাসিত রাজ্যগুলোর প্রায় সব ক’টি ভারতের অংশ হতে রাজি হয়। কিন্তু বেঁকে বসে মুসলিম রাজা (নিজাম) শাসিত হায়দারাবাদ। রাজ্যটি নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

পাকিস্তান নামের পাশের মুসলিম রাষ্ট্রটি এমনিতেই ভারতের মাথাব্যাথার যথেষ্ট কারণ ছিল। এর মধ্যে ভারতের মানচিত্রের অভ্যন্তরেই একটি পৃথক রাষ্ট্র থাকবে তা দিল্লির শাসকরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন নি। হায়দারাবাদের নিজাম মীর ওসমান আলি খানকে দিল্লির পক্ষ থেকে রাজ্যে স্বায়ত্বশাসন বজায় রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে পররাষ্ট্র সংক্রান্ত সব বিষয় থাকবে দিল্লির হাতে। নিজাম এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এবং তিনি ভারতবর্ষের শেষ গভর্নর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে হায়দারাবাদকে পুরোপুরি স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। মাউন্ট ব্যাটেন নিজামের এ প্রস্তাবে রাজী হন নি। নিজামের সঙ্গে এক বছর ধরে চলা আলোচনার এক পর্যায়ে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে দিল্লি। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু হায়াদারাবাদে সামরিক অভিযান চালানোর বিষয়টি সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনায় রেখেছিলেন। কিন্তু সরদার বল্লভাই প্যাটেল নিজামকে ঘৃণা করতেন। তিনি সবার আগে সামরিক অভিযান চালানোর পক্ষে ছিলেন। এর জন্য তিনি নেহেরুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। নেহেরুকে তাই বাধ্য হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়।

৮২ হাজার ৬৯৮ বর্গমাইলের হায়াদারাবাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, মুদ্রা, বিমানব্যবস্থা, রেলওয়ে, রেডিও, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সবই ছিল। ১৯৪১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী, রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ। জনগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশই ছিল হিন্দু। তবে সেনাবাহিনীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপস্থিতি ছিল ৫ শতাংশ। ওই সময় রাজ্যের বার্ষিক আয় ছিল ৯ কোটি রুপি। ১৯৪৮ সালে হায়দারাবাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছিল ২৪ হাজার। এদের মধ্যে মাত্র ছয় হাজার ছিল নিয়মিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা। ১৯৪৪ সালে হায়দারাবাদের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ কাসেম রিজভীর নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় ‘রাজাকার’নামে একটি অনিয়মিত বাহিনী। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ২০ হাজার।

১৯৩০ সালের দিকে রাজ্যে হিন্দুদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে আন্দোলনে নামে আর্য সমাজ নামে একটি সংগঠন। এর সঙ্গে পরবর্তীতে যোগ দেয় হিন্দু মহাসভা। পরবর্তীতে হায়দারাবাদে প্রভাব বিস্তার করতে এই দুই দলকে মদদ দিতে শুরু করে দিল্লির কংগ্রেস। ১৯৪৮ সালে রাজ্যে মার্ক্সবাদীদের দমনে নামে নিজাম সরকার। মার্ক্সবাদীরা প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদেরকে দমন করতে গিয়ে রাজাকাররা বেশ কয়েকটি হিন্দু গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর অত্যাচার করে। এ ধরণের একটি সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন নেহেরু। হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হচ্ছে দাবি করে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি হায়দারাবাদে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন, যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন পোলো’।

১৩ সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দারাবাদ আক্রমণ করে। পাঁচদিনের যুদ্ধেই নিজাম বাহিনী পরাজিত হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পন করেন হায়দারাবাদের সেনা প্রধান মেজর জেনারেল এল ইদরুস। ব্যাস, এরপরেই শুরু হয়ে যায় পরাজিত মুসলমানদের ওপর ভারতীয় সেনা ও সশস্ত্র হিন্দুদের নির্যাতন, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। তাদের হাতে নিহত হয় কমপক্ষে ৫০ হাজার মুসলমান। আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হায়দারাবাদের ঘটনা খতিয়ে দেখতে লোকসভার সদস্য পণ্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন নেহেরু।

সুন্দরলালের নেতৃত্বাধীন কমিশন হায়দারাবাদের প্রায় সবগুলো গ্রামই পরিদর্শন করে। তার প্রতিবেদনে ২৭ থেকে ৪০ হাজার মুসলিমকে হত্যার কথা বলা হয়।

নির্যাতনের প্রমাণের বিষয়ে এতে বলা হয়, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ সদস্যরাই হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট ও অন্যান্য অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে সে ব্যাপারে আমরা অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি।’

বলা হয়,‘তদন্তে আমরা এও তথ্য পেয়েছি যে, সেনা সদস্যরা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকানপাট লুটপাটে উৎসাহ যুগিয়েছে। এমনকী অনেক ক্ষেত্রে সেনা সদস্যরা হিন্দুদের এসব অপরাধ করতে বাধ্য করেছে।’

অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় সেনারা নিজেরাই হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অনেক স্থানে সেনা সদস্যরা গ্রাম ও শহরগুলো থেকে মুসলিম যুবকদের ধরে নিয়ে এসে তাদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে।’

তবে তদন্তে এও বলা হয়, কয়েকটি স্থানে ভারতীয় সেনা সদস্যরা ভালো আচরণ করে এবং মুসলিমদের রক্ষা করে।

সুন্দরলালের নেতৃত্বাধীন নেহরু কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত এক গোপন নোটে হিন্দুদের ওই নির্মম জিঘাংসার বিবরণ দেয়া হয় এভাবে, ‘অসংখ্য স্থানে আমরা পঁচতে থাকা মৃতদেহপূর্ণ কুয়া দেখতে পেয়েছি। এ রকম একটি কুয়াতে আমরা একসঙ্গে ১১টি মৃতদেহ দেখতে পেয়েছি, যার মধ্যে শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখা এক নারীর মৃতদেহও রয়েছে।’

এতে আরো বলা হয়,‘আমরা অসংখ্য মৃতদেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের টুকরা গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখতেও দেখেছি। অসংখ্য স্থানে মুসলিমদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলতে দেখেছি আমরা। মৃতদেহ পোড়ানোর পর অবশিষ্ট হাড়গোড় এবং মাথার খুলিও পড়ে থাকতে দেখেছি আমরা।’

ওই সময় সুন্দরলালের প্রতিবেদন প্রকাশ  করেননি নেহেরু। তার এই সিন্ধান্তের বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাও দেননি নেহেরু। তবে ধারণা করা হয়, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বিষয়টি চেপে যান তিনি।

তথ্যসূত্র :
১. Hyderabad 1948: India's hidden massacre
২. Pandit Sundarlal Committee Report on the Massacres in Hyderabad



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ এপ্রিল ২০১৭/শাহেদ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ