ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অবশেষে গোছাপাড়ায় বধ্যভূমির প্রাচীর!

মামুন চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ২২ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অবশেষে গোছাপাড়ায় বধ্যভূমির প্রাচীর!

প্রাচীর নির্মাণ উদ্বোধনের আগে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এমপি কেয়া চৌধুরী

মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ : অবশেষে গোছাপাড়ায় বধ্যভূমির প্রাচীর নির্মাণ শুরু হয়েছে।হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার আমুরোড বাজারে সন্নিকটে এই গোছাপাড়া গ্রাম।

গোছাপাড়ার পাল বাড়ি ও ধোপা বাড়ির অবস্থান পাশাপাশি। বাসিন্দারাও সহজ সরল এবং শান্তিপ্রিয়।  অথচ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব চলে এই দুই বাড়ির ওপর। যা আজও এখানে অনেকের কাছে দুঃসহ স্মৃতির হয়ে আছে।

যুদ্ধ চলাকালে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখ পাক বাহিনী এ দুই বাড়িতে হানা দেয়। তারা লুটপাট চালিয়ে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। সেদিন বাড়ির পুরুষদের মধ্যে অক্ষয় চন্দ্র শুক্লবেদ্য,  যতীন্দ্র চন্দ্র শুক্লবৈদ্য, টেনু চন্দ্র শুক্লবৈদ্য, সুরেন্দ্র বট, রাখাল চন্দ্র শুক্লবৈদ্য, বিপিন পাল, হরেন্দ্র পাল, ভজেন্দ্র পালকে ধরে নিয়ে একে একে গুলি করে হত্যা করে।

এরমধ্যে কৃপেশ পালের বাঁশ তলায় গর্তে পুঁতে রাখা হয় অক্ষয় চন্দ্র শুক্লবৈদ্য,  যতীন্দ্র চন্দ্র শুক্লবৈদ্য, টেনু চন্দ্র শুক্লবৈদ্য, সুরেন্দ্র বট, বিপিন পাল, হরেন্দ্র পাল, ভজেন্দ্র পালকে।  রাখাল চন্দ্র শুক্লবৈদ্যের মৃত দেহ পাওয়া যায়নি।

নারীদের ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন শুরু করে তারা। এ নিরীহ বাসিন্দাদের অপরাধ, তারা নাকি মুক্তিবাহিনীকে খাবার দিয়ে সহায়তা করছিল। দেশ স্বাধীন হলো। কেউ পাল ও ধোপা বাড়ির লোকদের খবর নিচ্ছিলেন না।

এদিকে চেতনায়-৭১ হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর কন্যা (বর্তমানে এমপি) কেয়া চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে ২০০৭ সালে এ দুই বাড়ির সন্ধান পান। তিনি ঘটনাস্থলে এসে উভয় বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে হানাদারদের নির্যাতনের কাহিনী সম্পর্কে বিষদভাবে অবগত হন।

সেই থেকে কেয়া চৌধুরী ধোপা বাড়ির বাসিন্দা হানাদারদের হাতে নিহত রাখাল চন্দ্র শুক্লবৈদ্যের স্ত্রী বীরাঙ্গনা পুষ্প রাণী শুক্লবৈদ্য ও যতীন্দ্র চন্দ্র শুক্লবৈদ্যের স্ত্রী বীরাঙ্গনা মালতি রাণী শুক্লবৈদ্যকে নিয়ে কাজ শুরু করেন।

তিনি তাদেরসহ মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জের পঙ্গু, বীরাঙ্গনা ও সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া ৬ নারীকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন। তার ঐকান্তিক চেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর  পুষ্প রাণী ও মালতি রাণী শুক্লবৈদ্যসহ ৬ নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।

অপরদিকে হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত ৭ জনের বধ্যভূমির প্রাচীর নির্মাণে এমপি কেয়া চৌধুরী বরাদ্দ দেন। এ বরাদ্দের টাকায় বধ্যভূমি নির্মাণের পাশাপাশি ৫ শহীদের পরিবারের মধ্যে সোলার প্যানেল দেওয়া হচ্ছে। বাকী দুই শহীদের পরিবার প্রবাসে রয়েছে।

বরাদ্দ দেওয়ার পর ১৯ মে এমপি কেয়া চৌধুরী সরেজমিনে যান। সেখানে গিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্য ও নারী মুক্তিযোদ্ধাসহ তৃণমূলের লোকদের নিয়ে ৭ শহীদের বধ্যভূমিতে প্রাচীর নির্মাণ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পূর্বে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ।

এ সময় আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা পুষ্প রাণী শুক্লবৈদ্য ও মালতি রাণী শুক্লবৈদ্য। তাদের চোখের পানি যেন বাঁধ মানছিল না। এ অবস্থায় সবার চোখেই পানি এসে যায়।

এ সময় এমপি কেয়া চৌধুরী বলেন, ‘তাদের ঋণ কোন দিন শোধ হবার নয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৭ বছর। দেরিতে হলেও জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বরাদ্দ এনে  শহীদদের বধ্যভূমি নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করতে পেরে ভাল লাগছে।  প্রাচীর নির্মাণ হবার পর তাদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণে বরাদ্দ দেব।’

ধোপা বাড়ির বাসিন্দা মন্টু চন্দ্র শুক্লবৈদ্য বলেন, ‘পাক সেনারা আমার পিতা অক্ষয় চন্দ্র শুক্লবৈদ্য ও ভাই টেনু চন্দ্র শুক্লবৈদ্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। স্বজন হারিয়েও আমরা ছিলাম স্বীকৃতিহীন।আজ আমাদের স্বীকৃতি মিলেছে, আজ ৭ শহীদের বধ্যভূমিতে প্রাচীর হচ্ছে, এজন্য আমরা বর্তমান এমপির কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে স্বামীসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারান বীরাঙ্গনা মালতি রাণী শুক্লবৈদ্য ও পুষ্পরাণী শুক্লবৈদ্য। সম্পর্কে তারা ‘জা’।

মালতী রাণী শুক্লবৈদ্য জানান, একাত্তরের ১৩ জ্যৈষ্ঠ হানাদার বাহিনী তার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে স্বামী যতীন্দ্র শুক্লবৈদ্য, ভাসুর অক্ষয় শুক্লবৈদ্যকে পাল বাড়ির কাছে নিয়ে হত্যা করে। দেবর রাখাল শুক্লবৈদ্যকে গাড়িতে করে নিয়ে যায় এবং রাখালের স্ত্রী পুষ্পরাণী শুক্লবৈদ্য ও তাকে সুখদেবপুর গ্রামের রশিদ মিয়ার বাড়িতে জিম্মায় রাখে।

পরদিন ভোরে সেখান থেকে তাদেরকে দুর্গাপুর গ্রামের রজব আলীর বাড়িতে নিয়ে যায় এবং এক মাস আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। এরপর এক ভিক্ষুক নারীকে দিয়ে পুষ্প রাণী তার চাচার বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুলা গ্রামে খবর দেয়। তখন ওই এলাকার তৎকালীন চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ আত্মীয়-স্বজন এসে তাদেরকে উদ্ধার করে।

 

 

রাইজিংবিডি/হবিগঞ্জ/২২ মে ২০১৭/মামুন চৌধুরী/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়