ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কালজয়ী ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ২৭ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কালজয়ী ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন

ইবনে খালদুনের পোট্রেট চিত্র

শাহ মতিন টিপু : ইবনে খালদুন ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম।তার ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল মুকাদ্দিমা’ তাকে কালজয়ী এক ঐতিহাসিকের আসনে সমাসীন করেছে। তিনি মুকাদ্দিমা রচনা করেছিলেন ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগে মাত্র পাঁচ মাসের পরিশ্রমে। মুকাদ্দিমায় ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞান জ্ঞানের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন।

১৩৩২ সালের ২৭ মে তিউনিসে এই দার্শনিকের জন্ম। মৃত্যু ১৪০৬ সালের ১৯ মার্চ কায়রোতে।

ইবনে খালদুন ছিলেন মূলত একজন ঐতিহাসিক। তার পুরো নাম আবু জায়েদ আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ বিন খালদুন আল হাদরামি। তিনি ছিলেন একজন আরব মুসলিম পন্ডিত। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও অর্থনীতির জনকদের মধ্যে তাকে অন্যতম বিবেচনা করা হয়।

তিউনিসে জন্ম নেওয়া খালদুনের বেড়ে উঠা সেখানেই, কিন্তু জীবনের পূর্ণতাপ্রাপ্তি হয় কখনো ফেজে, কখনো আন্দালুসিয়া তথা স্পেনে কখনো কায়রোয়। পুরো উত্তর আফ্রিকা চষে বেড়িয়েছেন তিনি।

তার প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের হাতেখড়ি বাবার কাছে । তারপর স্থানীয় তিউনিসীয় আলেমদের কাছে বিদ্যার্জন করেন। আন্দালুসিয়া থেকে হিজরত করে অনেক গুণী পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ এসে তিউনিসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বালক ইবনে খালদুন এদের সংশ্রব লাভ করেন। আঠারো বয়স পর্যন্ত তার শিক্ষার্জনের কাল চলে। এ সময়েই মিশর থেকে মৌরিতানিয়া পর্যন্ত সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় ভয়াবহ প্লেগ রোগ দেখা দেয়।

এই প্লেগ রোগে তিনি তার পিতা-মাতাকে হারান।তখন তিনি মৌরিতানিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে বড় ভাই নিষেধ করায় আর যাননি। এরপর ডাক পেয়েছেন সুলতানের মোহররক্ষী হিসেবে কাজ করার জন্য, যখন তার বয়স বিশ বছরের নিচে। ইবনে খালদুনের পরের জীবন ছিল অনেকটাই অস্থিতিশীল।

তার জীবনে চড়াই-উৎড়াই খুব বেশিই ছিল।এরমধ্যেও ক্লাসিক্যাল ইসলামী শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি কোরআন মুখস্থ করেছিলেন তিনি। রাজনীতিতেও জড়িয়েছিলেন। তিনি বেশ ক’বার জেলও খাটেন। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদে আসীন হন, আবার নির্বাসনে যান।

আগেই বলেছি, এই মুসলিম দার্শনিক তার বই মুকাদ্দিমার জন্যই বেশি পরিচিত। এই বই ১৭ শতকের উসমানীয় দুই ইতিহাসবিদ কাতিপ চেলেবি ও মোস্তফা নাইমাকে প্রভাবিত করে। তারা উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রেও এই বইয়ের তত্ত্ব ব্যবহার করেন। ১৯ শতকের ইউরোপীয় পন্ডিতরা এই বইয়ের গুরুত্ব স্বীকার করেন এবং ইবনে খালদুনকে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করতেন।

ইবনে খালদুনের মতে, ইতিহাস শুধু ঘটনার সমষ্টি নয় বরং এটি গবেষণার উপযোগী একটি বিজ্ঞান। তিনি ইতিহাসের মাঝে দর্শনকে খুঁজে বের করেছেন। ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রয়োগ করেছেন সমাজতত্বে। এই বৈশিষ্ট্যের গুণে তিনি স্বতন্ত্র হয়েছেন পূর্ববর্তী ইতিহাস রচনাকারীদের থেকে।

ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইবনে খালদুন উদ্ভাবন করেছেন নতুন একটি পদ্ধতির। এই পদ্ধতির মৌল তত্ত্বগুলো পরবর্তীতে সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি তার মুকাদ্দিমায় দাবি করেছেন-‘এতে নতুন ভিত্তির খোঁজ পাওয়া যাবে এবং এর বিষয় বস্তু আগ্রহোদ্দীপক।....কোন সমাজকে বিশ্লেষণ করতে হলে তার অবস্থা, বৈশিষ্ট্য, সময়ে সময়ে যে সব ঘটনা বা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং যেসব অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রশ্নই উঠে না- এই তিনটি অবস্থাকে পৃথক করতে হবে।’

আবার তিনি তার সমাজতত্ত্বের পাঠ পরিক্রমার শুরুতে রেখেছেন নৃতত্ত্বের আলোচনা যা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইবনে খালদুন সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণায় নিজেকে ব্যাপৃত করেছিলেন।

ইবনে খালদুন সমাজ ও সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি একটি সাধারণ তত্ত্বের ধারণা দেন। অনুমান নির্ভর ধারণাকে বাদ দিয়ে পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে তিনি গুরুত্ব দেন। তার মতে, ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণই উপযুক্ত পদ্ধতি।

তিনি সাম্রাজ্যের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে পাঁচ ভাগে ভাগ করেন- ভূ-খন্ড বিজয়, সাম্রাজ্য গঠন, সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ, শক্তি হ্রাস এবং পতন। ইবনে খালদুনের ধারণায় একটি রাষ্ট্র এই পাঁচটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। তার মতে মানুষ যেমন শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য, জরা ও মৃত্যুর মধ্যদিয়ে জীবন শেষ করে তেমনি রাষ্ট্রের জীবনেও শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য, জরা ও মৃত্যু প্রক্রিয়ার মধ্যে অতিবাহিত হয়।

ইবনে খালদুন এমন এক যুগে জন্মেছিলেন যে যুগে ইসলামের শক্তি ও আধিপত্যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছিল। ইসলামি চিন্তা ধারা হয়ে পড়েছিল অনাহুত, অবহেলিত। এজন্যে ইবনে খালদুনের রচনাবলী সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। পাশ্চাত্যে ইবনে খালদুন পরিচিত হন ১৬৯৭ সালে। এর প্রায় শতাব্দী পরে ১৮০৬ সালে ফরাসী প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ স্যাল ভেল্টার দ্য সাকি মুকাদ্দামার কয়েকটি পরিচ্ছেদ অনুবাদ সহ তার জীবনী ছাপেন।

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপের গবেষকদের কাছে ইবনে খালদুন পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেন। এবার পাশ্চাত্য জানতে পারল ইসলামের ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার এই মহান গুণী সম্পর্কে। কারণ তিনি ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে এমন সব অর্থনৈতিক, দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন যা পাশ্চাত্য জানতে পেরেছিল আরও কয়েক শতাব্দী পরে। তারা দেখতে পান ইবনে খালদুনের তত্ত্বগুলোই আলোচিত হয়েছে তার এক শতাব্দী পরে ম্যাকিয়ভেলির(১৪৬৯-১৫২৭) রচনায় এবং আরো তিন চার শতক পরের ভিকো (১৬৬৮-১৭৪৪), মন্টেস্কু (১৬৬৯-১৭৫৫), এ্যডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০), অগাস্ট ক্যোঁৎ (১৭৯৮-১৮৫৭) প্রমুখের রচনায়।

প্রথমে মনে করা হত পাশ্চাত্যের গবেষকরাই এ সব তত্ত্বগুলোর আবিষ্কর্তা। কিন্তু পরে গবেষণায় পাওয়া গেল গামবাতিস্তা ভিকোর পূর্বেই আরবীয় পন্ডিত ইবনে খালদুন ইতিহাসের দর্শন ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ভিকো নব বিজ্ঞান বা The new science বলে যে দাবি করেছেন তা আসলে উত্তর আফ্রিকার সেই রাজকর্মচারী ইবনে খালদুনের মাথায় ঢুকেছিল অনেক আগেই। অগাস্ট ক্যোঁৎ Sociology নামে একটি শব্দ পাশ্চাত্যের অভিধানে সংযোজন করেন। কিন্তু তার পাঁচ শতাব্দী আগে প্রাচ্যের অভিধানে তা শোভা বর্ধন করেছিল। ইবনে খালদুন তার মতবাদসমূহ শুধু উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সেসবকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ মে ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়