ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

একটি মসজিদের সন্ধানে

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৬ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একটি মসজিদের সন্ধানে

আতিয়া মসজিদ

শাহেদ হোসেন : চারপাশে চিকন সাদা বর্ডারের নব্বই দশকের সেই লাল রঙের ১০ টাকার নোটটির কথা মনে আছে? আজকের ১০০ টাকার নোটের প্রায় সমমাপের ওই নোটটিতে ভারী সুন্দর একটি মসজিদের ছবি ছিল। ছবির নিচে লেখা ছিল আতিয়া জামে মসজিদ, টাঙ্গাইল।

পরিবর্তনের হাওয়ায় ১০টাকার নোট থেকে হারিয়ে গেছে সেই আতিয়া মসজিদের ছবি।

ঐতিহাসিক এই মসজিদটি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায়। টাঙ্গাইল শহর থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় পাথরাইল, সেখান থেকে ব্যাটারি চালিত রিকশায় দেলদুয়ারের আটিয়া গ্রাম (গ্রামের নাম আটিয়া আর মসজিদটির নাম আতিয়া)। সবমিলিয়ে  প্রায় আধাঘণ্টায় পাড়ি দেয়া হলো আট কিলোমিটার পথ।

পাথরাইল থেকে আটিয়া যাওয়ার পথে চারপাশে যে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য, তা দেখলে ভ্রমণের প্রায় ষোল আনাই উসুল হয়ে যাবে।



পরিত্যাক্ত সওদাগর মসজিদ


আটিয়ায় অটোরিকশা থেকে নামার পর ডানদিকেই পড়বে আদম শাহ্ বাবা কাশ্মিরী (রহ.)- এর মাজার। আটিয়া গ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে বিখ্যাত এই সূফি সাধকের নামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। টাঙ্গাইলের ইতিহাস ঘেটে জানা গেল,  পঞ্চদশ শতকে আদম শাহ্ কাশ্মিরী ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য এই এলাকায় এসেছিলেন। বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ  জনকল্যাণের জন্য তাকে আটিয়ার জায়গির হিসেবে নিযুক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে কররানি বংশের শাসক সুলাইমান কররানি ধর্মীয় কাজ পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের জন্য এলাকাটি আদম শাহ কাশ্মিরীকে দান করেন। এই দানের আরবি শব্দ আতা থেকেই আতিয়া নামের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। মানুষের মুখে এই আতিয়াই পরে হয়ে যায় আটিয়া।

সাধারণত বিভিন্ন মাজারে যতোটা জৌলুস দেখা যায় আর আগরবাতির ঘ্রাণ মৌ মৌ করে সে তুলনায় আদম শাহ কাশ্মিরীর মাজার একেবারেই ম্লান। এখানকার পুরো পরিবেশ শান্ত। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে এই সুফি সাধক তার প্রিয় ভক্ত সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগণার শাসনভার অর্পণ করেছিলেন। তার পরামর্শক্রমে  এবং সুবেদার ইসলাম খাঁর সুপারিশে বাদশাহ জাহাঙ্গীর ১৬০৮ সালে সাঈদ খানকে আতিয়া পরগণার শাসনর্কতা নিয়োগ করেন। এই সাঈদ খানই হচ্ছেন করটিয়ায় জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা।

মাজার থেকে একটু এগিয়ে গেলে বাম দিকে রয়েছে আদম শাহ কাশ্মিরীর নামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা। এর সঙ্গে প্রায় লাগোয়া মুঘল আমলে লাল ইটের নির্মিত এক গম্বুজের মসজিদটি দেখে রীতিমতো ভ্যাবচ্যাকা খেতে হবে নতুন লোকদের। কারণ, প্রায় চারশ বছরের পুরোনো এই মসজিদটিকেই মনে হবে আতিয়া মসজিদ। তখন আনমনেই মুখ থেকে বের হয়ে যাবে, ‘হায় আল্লাহ! এইটা আতিয়া মসজিদ! এইটা কোনো কথা হইল? এই মসজিদের এই হাল!’

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এটি হচ্ছে সওদাগর মসজিদ। মসজিদের পশ্চিমে রয়েছে লৌহজং নদী। এখন অবশ্য নদীর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ, মানবদখল আর নির্যাতনে নদীটি মৃতপ্রায়।

যাহোক, মুঘল আমলে এক সওদাগর এখানে বাণিজ্য করতে এসেছিলেন। তিনিই এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। আতিয়া মসজিদ প্রতিষ্ঠার পরই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এতটা কাছাকাছি দুটি মসজিদ কেন, আর এই প্রাচীন মসজিদ এতটা বেহাল কেন? এর কোনো সদুত্তর নেই তাদের কাছে। দুঃখের বিষয়ে হচ্ছে, টাঙ্গাইলের স্থাপত্য নিয়ে লেখা বইগুলোতেও এই মসজিদের অস্তিত্ব নেই।

 

মসজিদের সীমানা প্রাচীরে শুকাতে দেওয়া হয়েছে কাপড়


মাদ্রাসা পেরিয়ে ডানদিক ধরে দুই মিনিট এগুনোর পর চোখে পড়লো আতিয়া মসজিদ। ১৯৮২ সালে বাজারে ছাড়া ১০ টাকার নোটে যেমনটা ছিল, ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ১৬০৯ সালে নির্মিত মসজিদটি। মসজিদের পূর্ব দিকে রয়েছে একটি বিশাল দিঘী। স্থানীয়রা জানালেন মসজিদের মতো দিঘীটিও প্রাচীন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে  আতিয়া মসজিদ সম্পর্কে লেখা হয়েছে ৬৯ ফুট x ৪০ ফুট পরিমাপের এই মসজিদটির প্রধান কক্ষের উপরে একটি গম্বুজ এবং বারান্দার উপর ছোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশপথ। মসজিদটিতে প্রাক মুঘল এবং মুঘল যুগের স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে।’

মাঝের দরজার ওপরের দেয়ালে  মসজিদের পরিচিতি উৎকীর্ণ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মিহরাব। প্রধান কামরার প্রত্যেক দেয়ালের সঙ্গে দুটি করে পাথরের তৈরি স্তম্ভ আছে। মিহরাবগুলোতেও পোড়ামাটির ফলকের কাজ আছে। তবে দেয়ালের উপরের যে চিত্র ফলক ছিল সেগুলো বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গেছে।

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি বইটিতে লিখেছেন, বর্গাকৃতি মসজিদটির ভেতরে প্রত্যেকটি বাহু ২৫ ফুট করে লম্বা। দেয়ালগুলি সাড়ে সাত ফুট পুরু। মসজিদের মূল অংশে যে বড় গম্বুজটি রয়েছে তার ব্যাস ২৫ ফুট।

মসজিদটির চার কোনায় চারটি মিনারও রয়েছে। এগুলো সব অষ্টকোণাকৃতির। মিনারগুলো ছাঁদের উচ্চতা ছাড়িয়ে গম্বুজের কাছাকাছি যেয়ে শেষ হয়েছে। মসজিদটির উত্তর ও পূর্ব পাশে পোড়ামাটির কারুকার্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল সুন্দর গোলাকৃতির ফুল। মসজিদের পূর্ব আঙ্গিনায় একটি পাকা কবর আছে। এটি আসলে কার কবর সেটি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কবরের পাশে একটি পাকা করা সুড়ঙ্গ পথও রয়েছে। যার স্থানীয় নাম ‘আন্ধার মানিক’। এ সুড়ঙ্গ পথটি বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পূর্ব পাশে দাঁড়িয়ে যখন একের পর এক ছবি তুলছিলাম, তখন আচমকা পেছন থেকে কে একজন বলে উঠলো, ‘এহানে ৩৬৫ রকমের নকশা আছে। একটা থাইকা আরেকটা আলাদা। কেউ এইডা দেহে না।’ পেছন ফিরেই দেখতে পেলাম ৭০ এর কোঠা ছুঁইছুঁই করছে এক ব্যক্তি। সবিনয়ে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে জানালেন, এই গ্রামেই তার বাড়ি। নাম জামাল উদ্দিন। এরপরে তিনি যে বাক্যটি বললেন, তাতে আমার ভিড়মি খাওয়ার দশা। তিনি বললেন, ‘আমার ১৩৯ জন লাতিন (নাতনি), কোনো লাতি (নাতি) নাই!’

 

মসজিদের মূল প্রবেশ পথ


- বিয়ে কয়টা করেছেন?

-একটা।

-মানে?

-হ, একটা করছি। তয় এই ছেলেমেয়েগুলো সব আমার আর পরীগো সন্তান। চাইর পরীরে বিয়া করছি।

এরপর তিনি পরীদের সঙ্গে তার বিয়ের কাহিনী বলতে শুরু করলেন। ততক্ষণে আমার আগ্রহ রীতিমতো উবে গেছে।

মসজিদ দেখা শেষ, এখন ফিরে যাওয়ার পালা। ফেরার জন্য যতই তাড়া করি, ততোই জামালউদ্দিন তার গল্পের পারদ চড়াতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ১৩৯ জন নাতনি আর পরীর সঙ্গে বিয়ের গল্প শুনে রেহাই মিললো।

ঢাকায় ফিরে আতিয়া মসজিদের ইতিহাস ঘেটে জানা গেল, সাঈদ খান পন্নী ১৬০৯ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। শ্রদ্ধেয় পীর আদম শাহ কাশ্মিরীর প্রতি সম্মান জানাতেই তিনি মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।

১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরাণী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবী মসজিদটি সংস্কার করেন।

প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে থাকলেও ফেরার সময় দেখলাম মসজিদের সীমানা প্রাচীরে কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। মসজিদের প্রবেশ মুখে এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা লেখা থাকলেও কে শোনে কার কথা!



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুন ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়