ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘ময়নামতীর চর’র কবি

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১০, ১৭ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ময়নামতীর চর’র কবি

শাহ মতিন টিপু : বন্দে আলী মিয়াকে অনেকেই কবিতায় গ্রামীণ দৃশ্যাবলির ভাষ্যকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। চিত্রকর হিসাবে একটি পরিচয় রয়েছে এই কবির। তুলির মতো বাস্তবেও তিনি গ্রামীণ জীবনের নিদারুণ চিত্র কবিতায় তুলে ধরেছিলেন।

এই কবিকে চিনতে একটি কবিতাই যথেষ্ট।আর তা হচ্ছে ‘ময়নামতীর চর’। এই কবিতাটির জন্য তাকে ‘ময়নামতীর চর’র কবি বলেও সমসময়ে অনেকে আখ্যায়িত করতেন। অবশ্য তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামকরণও এই কবিতাটির শিরোনাম দিয়ে হয়েছিল। যার প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ ‘ময়নামতীর চর’ সম্পর্কে লিখেছেন- ‘তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। তোমার রচনা সহজ ও স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলো যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হওনি, তাতে করে কবিতাগুলো আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’ (২৬ জুলাই ১৯৩২)।

রবীন্দ্রনাথের অভিমত ও মূল্যায়ন-ভাষ্য বন্দে আলীর কবি-অভিব্যক্তিকে আন্দোলিত করে কাব্যজীবনের সূচনালগ্নেই। কবি বন্দে আলী মিয়ার আজ ২৭ জুন ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীর কাজীহাটের বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে পাবনার রাধানগরের ‘কবিকুঞ্জ’তে তাকে সমাহিত করা হয়।

গল্প, উপন্যাস, নাটক, শিশু-কিশোরতোষ প্রভৃতি বিচিত্র মাধ্যমে সাহিত্যচিন্তার প্রকাশ ঘটালেও বন্দে আলী মিয়ার স্বচ্ছন্দবিচরণ ছিল কবিতা-আসরে। ‘ময়নামতীর চর’ পড়লেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিরচেনা গ্রামের চিরন্তন চিত্র। যেমন-

 

‘বরষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর

গাঙ-শালিকেরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।

গহিন নদীর দুই পার দিয়া আঁখি যায় যত দূরে

আকাশের মেঘ অতিথি যেন গো তাহার আঙিনা জুড়ে।

মাছরাঙ্গা পাখি একমনে চেয়ে কঞ্চিতে আছে বসি

ঝাড়িতেছে ডানা বন্য হংস-পালক যেতেছে খসি।’

তার কবিতার কথামালায় আছে চরজীবন নিসর্গ আর গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার বর্ণনার কারুকার্য। নদীপারের মানুষের জীবন, নদীর ভাঙাগড়া, সেখানকার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা সবই যেন স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।

তার কবিতায় রয়েছে, কাজের সন্ধানে দূরগাঁয়ে ছুটে যাওয়া দিনমজুরের কষ্টকথা, আপনজনের জন্য তার বিরহীমনের হাহাকার । বন্যায় আক্রান্ত শিকারি ফৈজুর বর্ণনা। যেমন :

‘হাওরে পড়েছে ঢল

পানির শব্দে ফৈজু গাজীর মন হলো চঞ্চল।

ভোর হতে ফৈজু চলিল গাঁয়ের দক্ষিণ সীমানায়

পানি আসিয়াছে হাওর ভরিয়া-মাঠে মাঠে স্রোত যায়।’

আবার

‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,

থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।

পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,

এক সাথে খেলি আর পাঠশালায় যাই।’

অথবা

‘বর্ষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠিয়াছে চর

গাঙ শালিকের গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।’

ময়নামতির চরের মতো ও বিখ্যাত কালজয়ী কবিতার এই রচয়িতার জন্ম ১৯০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি পাবনার শহরের রাধানগরের নারায়ণপুর মহল্লায় । তার বাবার নাম মুন্সী উমেদ আলী মিয়া এবং মাতা নেকজান নেসা। কবির শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাবনার গ্রামীণ ও নাগরিক পরিমন্ডলে।

১৯২৬ সালে তার বাবার ইচ্ছানুসারে শহরের জেলাপাড়া মহল্লার রাবেয়া খাতুনের সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি আরো তিনটি বিয়ে করেন। ওই তিন স্ত্রীর নাম হেনা, শামসুন্নাহার ও পরীবানু। তিনি ১৯২৭ সালে কৃতিত্বের সাথে চিত্র বিদ্যায় ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেন ।

প্রায় ১৬ বছর কবি কলকাতায় করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কলকাতায় থাকার সুবাদে সমকালীন পত্রপত্রিকার সাথে কবি বন্দে আলী মিয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর কিছুদিন পর কবি ‘ইসলাম দর্শন’ -এর সাথে জড়িয়ে যান। করপোরেশন স্কুলে শিক্ষক থাকাকালে তিনি ‘কিশোর পরাগ’, ‘শিশু বার্ষিকী’, ‘জ্ঞানের আলো’ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও জড়িত ছিলেন।

কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৬২ সালে শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। পরে ১৯৬৫ রাজশাহী বেতারকেন্দ্রে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন এবং একই বছর সাহিত্য-প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। কবি বন্দে আলী মিয়াকে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকারের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।

তিনি সারা জীবন বাংলা সাহিত্যের ভুবনে আচ্ছাদিত ছিলেন। কবির জীবনকালে নানা সমস্যার-জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। সুখ যেমন তার সাথী ছিল তেমনি দুঃখও ছিল তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কবি বন্দে আলী মিয়া দুঃখকে আঁকড়ে ধরে ধৈর্যের সঙ্গে প্রবহমান সময় অতিবাহিত করলেও কখনও সাহিত্য চর্চায় পিছুটান হননি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুন ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়