ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

এই দিনে ‘তাহারেই মনে পড়ে’

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২০ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এই দিনে ‘তাহারেই মনে পড়ে’

রুহুল আমিন : কবিরা অমর হয়ে থাকেন তার রচিত পংক্তিমালার জন্য। কবিদের বিশেষত্বই এই যে, সাধারণরা তাদের মতো মনে দোলা লাগানো কথার মালা সাজাতে পারেন না।

“হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,

বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”

কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-

“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?

বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?

দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?” (তাহারেই মনে পড়ে : সুফিয়া কামাল)

প্রথিতযশা কবি, লেখিকা ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম সুফিয়া কামালের জন্মদিন আজ। ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদের এক নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মদিনে এই বরেণ্য কবিকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।

সুফিয়া কামালের বাবার নাম সৈয়দ আব্দুল বারী এবং মায়ের নাম সৈয়দা সাবেরা খাতুন। তার বাবা কুমিল্লার বাসিন্দা ছিলেন। সুফিয়া কামাল যখন জন্ম নেন তখন বাঙালি মুসলিম নারীরা একরকম গৃহকোণেই আবদ্ধ ছিল। শিক্ষা গ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না। আর পরিবারে বাংলা ভাষার ব্যবহার একরকম নিষিদ্ধ ছিল। সেই বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। তিনি পারিবারিক নানা উত্থানপতনের মধ্যে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়ার যখন সাত বছর বয়স তখন তার বাবা সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। ফলে তাকে তার মা সাবেরা খাতুনের সঙ্গে অনেকটা বাধ্য হয়ে নানার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিতে হয়। এই কারণে তার শৈশব কেটেছিল নানার বাড়িতেই। তার মাতৃকূল ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবার এবং সেই পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। এখানেও নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হত না। অন্দর মহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বাংলা শেখেন মূলত তার মায়ের কাছে। নানাবাড়িতে তার বড় মামার একটি বিরাট গ্রন্থাগার ছিল। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তার।

১৯২৪ সনে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাত ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন।

১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। সেখানে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার দেখা হয়। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের আলাপ হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। সুফিয়া কামালের শিশুমনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলো বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সুফিয়া কামালের কাজেকর্মেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার।

সাহিত্যপাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা বাসন্তী সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রদের দেখা পান তিনি।

এই সময় সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। ১৯৩৭ সালে তার গল্পের সংকলন ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’র মুখবন্ধ লিখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায়। প্রশংসাকারীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন।

১৯৩২ সালে তার স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু তাকে আর্থিক সমস্যায় ফেলে। তিনি কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এর মাঝে ১৯৩৯ সালে কামালউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। দেশবিভাগের পূর্বে তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী বেগমের সম্পাদক ছিলেন।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেওয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবি জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন।

১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাসভবন সংলগ্ন গোটা ধানমন্ডি এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে ছিল। আর ওই সময় তিনি ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিরাপদে অবস্থান করেন ।

স্বাধীন বাংলাদেশেও নারী জাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।

৮৯ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান আমাদের সবার প্রিয় এই কবি। তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।

তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হল ‘সাঁঝের মায়া’, ‘একাত্তরের ডায়েরি’, ‘মায়া কাজল’, ‘উদাত্ত পৃথিবী’, ‘ইতল বিতল’, ‘কেয়ার কাঁটা’, ‘সোভিয়েত দিনগুলো’ ইত্যাদি। এক জীবনে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন বেগম সুফিয়া কামাল। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রাশিয়ার লেনিন স্বর্ণপদক, একুশে পদক, নাসিরুদ্দীন পদক, শেরেবাংলা জাতীয় সাহিত্য পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুন ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়