ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হিমু আমার প্রেম

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২০ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হিমু আমার প্রেম

ইয়াসিন হাসান: ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে স্কুলে নতুন ছাত্রের আগমন হলো। মাঝারি মানের ছাত্র ছিলাম বলে আমার রোল নাম্বার সব সময়ই মাঝের সারিতেই থাকত। স্কাউটিং করতাম বলে যদিও আমার পরিচিতি সে তুলনায় বেশি ছিল। ক্লাস টিচার নতুন ছাত্রকে সবার আগে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। সেই থেকে আজও আমরা একসঙ্গে। কলেজ, ভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়ার সুযোগ না হলেও আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরেনি। অনেকটাই আত্মার সঙ্গে মিশে আছি দুজন। আশা করছি বাকিটা পথ এভাবেই থাকবো।

তবে দুজনের বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল অসাধারণ এক ঘটনায়। সে কারণে আমার সারাজীবন মনে থাকবে ওকে। আমার তেমন বই পড়ার অভ্যাস ছিল না। ক্রিকেট মাঠ, বন্ধু-বান্ধবের আড্ডা ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। ক্রিকেট নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতাম। কে কোন রেকর্ড করত, কে কয়টি ছক্কা মারত, সেগুলো আমি স্কুলে সবার সঙ্গে আলোচনা করতাম। কিন্তু ওই বন্ধু ছিল আমার উল্টো। একদিনের আড্ডায় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, হুমায়ূন আহমেদকে চিনিস?

আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি ওকে উত্তর দিয়েছিলাম, না। কোন দেশের প্লেয়ার? নাম তো বাংলাদেশি মনে হচ্ছে। কোন ক্লাবের? বল না।

সবার সামনে আমাকে কড়া ভাষায় অপমান করে সে বলেছিল, বেটা কোনো দেশের প্লেয়ার না। লেখক হুমায়ূন আহমেদ।

আমি তখন গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলাম, ধুর বেটা! সিরিয়াস আড্ডায় এগুলো কি বলিস। অন্য কথা বল। কোথাকার কে!

বন্ধু আমার কথায় সেদিন খুব অপমানিত হয়েছিল। আড্ডা ছেড়ে নিজের সিটে গিয়ে বসে ছিল। বুঝতে পারছিলাম, ও হয়ত রাগ করেছে। হুয়ামূন আহমেদ হয়ত ওদের কোনো আত্মীয়। এভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে ‘সরি’ বলে জানতে চাইলাম, ‘কিরে, হুমায়ূন আহমেদ তোর কি হয়?

ও বলেছিল, আমার কিছু হয় না। আমি তার লেখা পড়ি। বাবা সব সময় তার বই কিনে পড়ে। আমিও পড়ি মাঝে মাঝে। অনেক সময় তার লেখা বুঝি না। কিন্তু খুব ভালো লাগে পড়তে।

বন্ধুর কথা শুনে আমারও আগ্রহ হলো। ওকে বললাম, আচ্ছা, আঙ্কেল আর তোর পড়া হলে যেকোনো একটা বই আমাকে দিস তো। পরের সপ্তাহে আমার জন্য হিমু বইটি নিয়ে এসেছিল ও। হুমায়ূনপ্রেমীদের জন্য হিমু বিশেষ কিছু। অসাধারণ একটি উপন্যাস। আমি তখন উপন্যাস কি বুঝতাম না। আমার মনে নেই আমি হিমু বইটি পড়ে কি বুঝেছিলাম! কিন্তু সত্যি কথা সেদিন থেকে হিমুর প্রেমে পড়েছিলাম। সেই থেকে হিমু আমার প্রেম। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের অন্যান্য লেখার ওপর আমার ততটা আগ্রহ নেই, যতটা না হিমুকে নিয়ে আছে। যতটুকু আমি জানি হিমুকে নিয়ে স্যার বই লিখেছেন ২৫টি। যার প্রতিটি আমার একবার হলেও পড়া হয়েছে। হিমুকে নিয়ে স্যারের প্রথম উপন্যাস ময়ূরাক্ষি’। শেষ উপন্যাস হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D. বল্টু ভাই যেটি স্যার নিউইয়র্কে বসে লিখেছিলেন ২০১১ সালে। হিমু চরিত্রটি স্যারের কাল্পনিক চরিত্র হলেও স্যার সব সময় নিজেকে হিমু মনে করতেন বলেই আমার মনে হয়েছে।

হিমু বইটিতে স্যার লিখেছিলেন: ‘হিমু আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। যখন হিমুকে নিয়ে কিছু লিখি- নিজেকে হিমু মনে হয়, এক ধরনের ঘোর অনুভব করি। এই ব্যাপারটা অন্য কোনো লেখার সময় তেমন করে ঘটে না। হিমুকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা ময়ূরাক্ষি। ময়ূরাক্ষি লেখার সময় ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ করি। দ্বিতীয়বার লিখলাম দরজার ওপাশে। তখনো একই ব্যাপার। কেন এরকম হয়? মানুষ হিসেবে আমি যুক্তিবাদী। হিমুর যুক্তিহীন, রহস্যময় জগৎ একজন যুক্তিবাদীকে কেন আকর্ষণ করবে? আমার জানা নেই। যদি কখনো জানতে পারি- পাঠকদের জানাব।’

এরপর স্যার হিমু চরিত্রকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন উপন্যাসে তুলে এনেছেন। স্যারের অনবদ্য সৃষ্টিতে পাঠক বিমোহিত হয়েছে বারবার। নিজেকে হিমু ভাবতে শুরু করেছে অনেকেই। হলুদ পাঞ্জাবি মানেই হিমু। রাতের বেলায় খালি পায়ে ঘুরে বেরানো মানেই হিমু। বেকার থেকেও মানুষের কল্যাণে কাজ করা মানেই হিমু। বড় ডিগ্রি না থাকলেও সাধারণ জ্ঞান দিয়ে মানুষকে ভালো পরামর্শ দেয়া মানেই হিমু। লোভ, লালসা, ঈর্ষা, অকুতোভয় মানেই হিমু। বুদ্ধিমান ও রসবোধসম্পন্ন ব্যক্তি মানেই হিমু। সব মিলিয়ে হিমু এমন এক চরিত্র যার প্রেমে পড়তে কোনো বাধা নেই, নেই কোনো বয়স। 

স্যার আজ নেই। হিমু চরিত্র নিয়ে নতুন কোনো উপন্যাস তৈরি হবে না। কিন্তু স্যার হিমুকে অমরত্বের স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। আজ আমার মনে পড়ছে সেই বন্ধুকে যে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল হিমুর সঙ্গে। নইলে আমি অনেকটা পথ পিছিয়ে থাকতাম।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুলাই ২০১৭/ইয়াসিন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়