ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

উ প কূ লে র  প থে

ভাঙনে নিঃস্ব মানুষ, দাবি পুনর্বাসনের 

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৯, ২১ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাঙনে নিঃস্ব মানুষ, দাবি পুনর্বাসনের 

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ভোলার ইলিশা ঘুরে : মেঘনার ভাঙনে ক্ষতবিক্ষত জনপদ। মানুষ ছুটছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। সংকট জীবন-জীবিকায়। অনেকেরই ধার-দেনায় দিন চলছে। এলাকায় কাজ না থাকায় কেউ রোজগারের সন্ধানে শহরে ছুটেছে। একদিকে ভাঙনের কারণে বাড়িঘর বদলের তাড়া, অন্যদিকে ভরা মৌসুমেও নদীতে নেই ইলিশ। ফলে মেঘনাতীরের মানুষের ঘরে সংকট বেড়েই চলেছে।

সরেজমিন ঘুরে দ্বীপ জেলা ভোলার মেঘনাতীরে এমন চিত্র মেলে। মেঘনার তীর ঘেঁষা ইলিশা ও রাজাপুর ইউনিয়নের বহু গ্রামের মানুষের এই দুর্ভোগ গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত। গত তিন বর্ষায় এই এলাকায় নদী ভাঙন আকার ধারণ করে। ফলে বহু মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে পথে বসে। নদীভাঙন রোধে প্রকল্প গ্রহণের ফলে এবার ভাঙনের তীব্রতা কিছু কমলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিন মজুরসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা চরম সংকটে দিন অতিবাহিত করছেন।

সংকটের কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন ইলিশার বাসিন্দা মোবারক হোসেন। পেশায় জেলে। নদীভাঙনে বাড়িঘর হারিয়েছেন। মাছ ধরেই তার জীবিকা চলে। কিন্তু এবারের বর্ষায় নদীতে তেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বর্ষায় এই এলাকায় সংকটের এটাই প্রধান কারণ বলে জানালেন তিনি। মোবারকের কথায় সায় দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইদ্রিস আলী, মমিনউদ্দিন বললেন, এই এলাকায় ৯০ ভাগ মানুষের জীবিকা মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। বর্ষায় ইলিশের মৌসুমে বাড়তি রোজগার দিয়ে তারা সংকট মোকাবিলা করে, ধার-দেনা শোধ করে। কিন্তু এবার সেই সুযোগ আর নেই। মেঘনায় ইলিশের দেখা মিলছে না।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, বর্ষাকালে এই এলাকার মাছঘাটগুলো জমজমাট থাকে। শত শত জেলে নদী-সমুদ্র থেকে মাছ নিয়ে ফেরে এই মাছঘাটে। সে কারণে ঘাটগুলো রাতদিন ব্যস্ত থাকে। কিন্তু একদিকে ভাঙণের কারণে মানুষগুলো বার বার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বদল করতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে মাছঘাটগুলোও ছোট হয়ে যাচ্ছে। অনেকে পেশাও ছেড়ে দিচ্ছে। এবারের বর্ষায় আশানুরূপ ইলিশ না পাওয়ায় মাছঘাটগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ছে। জেলে এবং মাছের আড়তদারেরা সরাসরি মাছ ধরা ও বাজারজাতকরণে সম্পৃক্ত থাকলেও আরো অনেক শ্রেণির মানুষ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে ইলিশ না পড়ার প্রভাব পড়ছে সংশ্লিষ্ট সবার ওপরেই।



রাজাপুর ইউনিয়নের গন্ধবপুর গ্রামের বাসিন্দা কবির হোসেন (৪০) বলেন, নদীভাঙনে সব হারানোর পরেও কষ্ট করে মেঘনার তীরেই আছি। কারণ একটাই, মাছ ধরে ধার-দেনা শোধ করে সুন্দর জীবনযাপন করবো। কিন্তু এবার ভরা মৌসুমে ইলিশ না পাওয়ায় আমরা বিপদে পড়েছি। অনেক টাকা দেনার বোঝা নিয়ে বেড়াচ্ছি। ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়কালে জেলেরা ধার-দেনা করে সংসার চালায়। সেই টাকা শোধ হয় ইলিশ মৌসুমে। কিন্তু এবার সে সুযোগ হলো না।

নদীভাঙনের সঙ্গে নদীতে ইলিশ না পাওয়া এই এলাকার মানুষদের সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানালেন রাজাপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জামাল হাওলাদার। তিনি বলেন, মাছঘাটে আমার একটি ছোট হোটেল আছে। তিন বছরে এই হোটেলটি কয়েকবার স্থানান্তর করতে হয়েছে। মাছঘাট এবং মানুষের বসতবাড়ি বারবার স্থানান্তর হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। একসময় বাপদাদার অনেক সম্পত্তি থাকলেও এখন এই হোটেলটিই আমার জীবিকার অবলম্বন। কিন্তু এবার ভাঙনে নিঃস্ব হওয়া মানুষেরা নদীতে মাছ না পাওয়ায় সব ক্ষেত্রেই ধস নেমেছে।

রাজাপুর ইউনিয়নের জোড়খাল এলাকায় জামাল হাওলাদারের হোটেলের পাশে একটি ছোট মাছঘাট। মাত্র ১২জন আড়তদার রয়েছেন এখানে। এক সময় সংখ্যা আরো বেশি থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা কমছে। আড়তদার মিজানুর রহমান জানালেন, গত বছর বর্ষায় ইলিশ মৌসুমে যেখানে এই মাছঘাটে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার মাছ উঠেছে এই ঘাটে, সেখানে এবার দৈনিক লাখ টাকার ইলিশও আসে না। এর ফলে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য আর মানুষের জীবন-জীবিকায় সংকট দেখা দিয়েছে।

রাজাপুরে মেঘনাতীরের ভাঙন কবলিত মানুষে সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে বাঁধের ধারে ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছে। অনেকে কিছু সম্পদশালীদের বাড়িতে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছেন। রাজাপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ভাঙন এই এলাকার মানুষদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এই ওয়ার্ডে অন্তত ৭ হাজার মানুষ ভূমিহীনের তালিকায়। কখনো কখনো তাৎক্ষণিক জরুরি সহায়তা মিললেও পুনর্বাসনের জন্য এরা কোন ধরনের সহায়তা পায়নি।

গত দুই বছর ভোলার ইলিশা ও রাজাপুরে ব্যাপক ভাঙনের পর ভাঙনরোধে প্রকল্প গৃহীত হয়। এর ফলে এবার ভাঙন কিছুটা কমেছে। কিন্তু এবারের বর্ষায়ও এই এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। ভাঙন রোধের পাশাপাশি এলাকার মানুষের দাবি, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের। বাসিন্দারা বলেছেন, বাপদাদার ভিটেমাটি হারিয়ে এই এলাকার বহু মানুষ পথে বসেছে। তিনবেলা খাবার সংগ্রহে তারা হিমশিম খাচ্ছে। এদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

তবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। গত মঙ্গলবার ইলিশার ভাঙনরোধে গৃহীত প্রকল্প পরিদর্শনে এসে তিনি এলাকাবাসীকে এ আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ভাঙন রোধে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।  



রাইজিংবিডি/ভোলা/২১ জুলাই ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়