ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ২৫ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর

শাহ মতিন টিপু : সর্বজনে বিস্তৃত রয়েছে, তিনি আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর ।কেউ বলেন একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব । আসলে নিজ কর্মগুণে তিনি হয়ে উঠেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি । তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ।

বাংলাদেশের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই সমাজসংস্কারকের জন্মদিন আজ। ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই তিনি  জন্মগ্রহণ করেন ।পার্ক সার্কাস, কলকাতায় তার জন্ম । মানুষ গড়ার কারিগরের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।

মূলত তিনি শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। ষাট দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি । সমালোচক এবং সুবক্তা । তিনি টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যা বাংলাদেশে আলোকিত মানুষ তৈরির কাজ করে যাচ্ছে। নানাবিধ লেখালেখির মধ্য দিয়ে আজো তিনি স্বীয় লেখক পরিচিতি বহাল রেখেছেন।

আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ খুব অল্প বয়সে মাকে হারান। তিনি ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয়। আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদের জীবনে তার পিতার শিক্ষা ও আদর্শের প্রভাব সুস্পষ্ট। অধ্যাপনা করেছেন তিনি তিরিশ বছর-১৯৬২ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত।  তিনি বলেন, 'শিক্ষক হিসাবে আব্বা ছিলেন খ্যাতিমান। ১৯৫০ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, আব্বা তখন পাবনা এডোয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তার কথা উঠলে এমন সশ্রদ্ধ উদ্বেলতায় উপচে পড়ত যে মনে হত কোনো মানুষ নয়, কোনো দেবতা নিয়ে তারা কথা বলছে। একজন ভালো শিক্ষক ছাত্রদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ভালোবাসার যে কী দুর্লভ বেদিতে অধিষ্ঠিত থাকেন আব্বাকে দেখে তা টের পেতাম। একজন মানুষের এর চেয়ে বড় আর কী চাওয়ার থাকতে পারে। তখন থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম এই পৃথিবীতে যদি কিছু হতেই হয় তবে তা হবে শিক্ষক হওয়া, আব্বার মতোন শিক্ষক।’

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ব্যক্তিত্বের প্রায় সবগুলো দিক সমন্বিত হয়েছে তার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক সত্তায় । তিনি অনুভব করেছেন যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত মানুষ। আর তাই আলোকিত মানুষ গড়ায় ব্রতী হয়েছেন তিনি ।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্ম ১৯৭৮ সালে। প্রথমদিকে তার তত্ত্বাবধানে মাত্র পঁচিশ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী বিশ্বের মহান সাহিত্যকর্মগুলো পড়তে ও সেগুলোর উপর আলোচনা করা শুরু করে। ধীরে ধীরে এই পাঠচক্রে স্কুল-কলেজ ও সাধারণ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পাঠচক্রগুলোতে বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বইগুলোর পঠন এবং সেগুলোর ওপর প্রাণবন্ত আলোচনা করা হয়। বর্তমানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৫০০টি শাখা দেশের মোট ৫৪টি জেলায় তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছে এবং এর সাথে যুক্ত আছেন বহু স্বেচ্ছাসেবী কর্মী।

বাংলাদেশে পাঠাগারের অপ্রতুলতা অণুধাবন করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ১৯৯৮ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রম আরম্ভ করে। নরওয়েজিয় সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এই কার্যক্রমে বই-ভর্তি একটি বাস পাঠকের দুয়ারে গিয়ে হাজির হয়। প্রথমদিকে কার্যক্রমটি ঢাকায় আরম্ভ হলেও আজ তা বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় বিস্তৃত হয়েছে।

শিক্ষাকতা জীবন খুবই বর্ণাঢ্য তার ।১৯৬১ সালে প্রথম শিক্ষকতায় যোগদান করেন মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে। তখন  বয়স বাইশ। ওই সময়ে মুন্সীগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তার বাবা আযীমউদ্দীন আহমদ। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার হিসাবে যিনি সেকালে দেশের সুধীমহলে সুপরিচিত । ছেলে একই কলেজে যোগ দিলে তার জন্য প্রশাসনিক অস্বস্তির কারণ হবে মনে করে তিনি কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সভায় আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদকে অন্তর্ভূক্তি করার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল ভাল থাকায় কলেজের গভর্নিং বডির সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে কলেজের খন্ডকালীন প্রভাষক হিসাবে তাকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। গভর্নিং বডির সচিব হিসাবে তার বাবাকেই তার নিয়োগপত্র পাঠাতে হয়েছিল। সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি জমে উঠেছিল কলেজে তার যোগদানের প্রথম দিনটিতে।

সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি এভাবে,  ‘প্রথম ক্লাশে ছাত্রদের সঙ্গে নতুন শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব অধ্যক্ষই পালন করতেন এটাই ছিল নিয়ম। আমার ব্যাপারেও আব্বাকেও তাই করতে হলো। রুটিন মাফিক আব্বার পেছনে পেছনে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির একটি শাখায় গিয়ে হাজির হলাম। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তার সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষণে আব্বা আমার একটা ছোটখাট পরিচয় তুলে ধরে সব শেষে বললেন, যেহেতু ওর শরীরে শিক্ষকের রক্ত আছে আমার মনে হয় ও ভাল শিক্ষকই হবে। আমার ধারণা ছিল, আমার নিয়োগের দ্বন্দ্বে পরাজয়ের ফলে উনি ভেতরে ভেতরে কিছুটা তেতে আছেন। হয়ত তার সেদিনের বক্তব্যে সেই ক্রোধের কিছু প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু ঘটনা হলো ঠিক উল্টো। বক্তৃতার সময় আব্বার গলা কিছুটা ধরেই এল। মনে হল তার উত্তরসূরির আসনে নিজ হাতে আমাকে বসিয়ে যেতে পেরে তিনি যেন ভেতরে ভেতরে গর্বিত এবং পরিতৃপ্ত।'

এরপর তিনি সিলেট মহিলা কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন । সেই সময় মহিলা কলেজে ঢোকা তরুণ অধ্যাপকের জন্য সহজ ছিল না। কারণ তখন সিলেটের সমাজ খুবই রক্ষণশীল । এখানে তিনি বেশিদিন ছিলেন না। চাকরি পাওয়ার মাস দুয়েক পরই বাম ছাত্র আন্দোলনের মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর তিনি যোগ দেন রাজশাহী কলেজে।  রাজশাহী কলেজের অত্যন্ত উচুমানের লাইব্রেরি তাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল । রাজশাহী কলেজে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি যোগ দেন ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে। বর্তমানে এই কলেজটি বিজ্ঞান কলেজ নামে পরিচিত। একই সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগেও তিনি খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে বাংলা পড়িয়েছেন। ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা করার সময় বছর দুয়েক তিনি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

এর পর  চলে আসেন ঢাকা কলেজে। তখনও সেরা কলেজ হিসাবে ঢাকা কলেজের খ্যাতি ছিল দেশজোড়া।  তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শত্তকত ওসমান।

ঢাকা কলেজের শিক্ষকতা জীবন তিনি অত্যন্ত উপভোগ করতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ঢাকা কলেজে প্রাণবন্ত, সপ্রতিভ, উজ্জ্বল ছাত্রদের পড়ানোর তৃপ্তি, শিক্ষক-জীবনের অনির্বচনীয়তম আস্বাদ ছেড়ে তিনি যেতে চাননি ৷

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মনে করেন, নবীন লেখক তৈরিতে প্রবীণদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। নবীন লেখকদের প্রতি প্রবীণদের সহযোগিতার মনোভাব থাকলেই তারা উঠে আসতে সক্ষম হবে।  ‘ডিআরইউ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬ অনুষ্ঠানে তিনি এই মনোভাব ব্যক্ত করেন । প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা প্রবীণ লেখক রয়েছি তাদের দিন আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় তরুণ লেখক তৈরি হচ্ছে না। ফলে তাদেরকে উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে সেই ঘাটতি পূরণের জন্য কাজ করতে হবে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুলাই ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়