ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এই বেশ ভালো আছি

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৭, ২৭ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এই বেশ ভালো আছি

শাহেদ হোসেন : রাজধানীর অনেক এলাকায় ভবনের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে গেলে বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে। লাগোয়া ভবনগুলোর জানালা খুলে আকাশ দেখতে গেলে প্রতিবেশী হয়তো ভেবে বসবেন আপনি বুঝি তার ঘরের বউয়ের দিকে উঁকি মারার তালে আছেন। তাই বৃষ্টির অবস্থা এখন আকাশে না তাকিয়ে টিভির দিকে তাকিয়েই জেনে নিতে হয়।

আজকাল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বদৌলতে কেবল আকাশ নয়, জমিনেও বৃষ্টির হাল-চিত্র দেখা যায়। বৃষ্টির কারণে কোথায় হাঁটু পানি, কোথায় গিরা পানি আর কোথায় কোমর পানি- রিপোর্টাররা রীতিমতো পানিতে নেমে তা মেপে মেপেই দেখান। সঙ্গে থাকে জনগণের অভিযোগ যার ইঙ্গিত মেয়রদের দিকে। মেয়রদের দিকে গেলে তারা আবার আঙ্গুল তাক করেন প্রশাসনের দিকে। সবই তাক-তাক খেলা।

আমরা বাঙালি বড়ই নির্বোধ। কোনো বস্তু বা ঘটনার ভবিষ্যত পরিণতি না ভেবেই লোকজনকে গালি-গালাজ করা আমাদের মজ্জাগত। এই বৃষ্টি আর জলজটের কথাই ধরুণ না। সরকারি দল আর প্রভাবশালীদের দাপটে রাজধানী থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে পুকুর, খাল-বিল। হাল আমলের শিশু-কিশোরদের পুকুর-বিল চেনাতে হলে নিয়ে যেতে হবে গ্রামে। বৃষ্টি হলে রাজধানীর পথ-ঘাটে যে জল থইথই পরিস্থিতি হয়, তাতে অন্তত শিশু-কিশোররা ক্ষণস্থায়ী খাল-বিল দেখতে পাচ্ছে।

‘দীঘিটি গিয়াছে ভরে, সিঁড়িটি গিয়াছে ডুবে,/ কানায় কানায় কাঁপে জল;/ বৃষ্টি-ভরে বায়ু-ভরে নুয়ে পড়ে বারে বারে।’ বর্ষায় গ্রামবাংলার প্রকৃতির অপরুপ এই বর্ণনা কিছুটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে নাগরিক পিতা-মাতারা সন্তানদের দেখাতে পারছেন। এছাড়া নগরীর অলি-গলিতে জল থইথইয়ের এ অপরূপ দৃশ্য দেখে তাদের ভেতরে হয়তো জন্ম নিতে পারে শিল্প-সাহিত্যবোধ।

অনেকেই অভিযোগ করেন, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে এখন আর ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া গান সৃষ্টি হয় না। তারা অবশ্য ভুলে যান যে, এক সময় বাংলায় অসংখ্য নদী-খাল-বিলের কল্যাণেই সৃষ্টি হয়েছিল ভাটিয়ালি গান। আমাদের একটু ভেবে দেখা উচিৎ, সেই ভাটিয়ালি গানের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আমাদের মেয়ররা কী প্রচণ্ড ভূমিকা রাখছেন। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো বর্ষামৌসুমে রাজপথগুলোতে বাসের বদলে চলবে নৌকা। তখন আমাদের ব্যান্ড তারকরা হয়তো বৈঠা হাতে ভাটিয়ালি সুরে গান তুলবেন, মাঝি বাইয়া যাও রে …।

জলজটের সমস্যা রাজধানী ঢাকার চেয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামেই বেশি। সেখানে একটু বৃষ্টি হলেই কোমর পানি। চট্টগ্রামের লোক নাকি এজন্য মেয়রের ওপর মহাখাপ্পা! কিন্তু তারা বৃষ্টির কোমর পানিতে তাদের সন্তানদের সাঁতার কেন শেখাচ্ছেন না- এটা বোধগম্য নয়। আজকাল সুইমিংপুলে সাঁতার শিখতে দুই থেকে দশ হাজার টাকা লাগে। অথচ মেয়র সাহেব বিনামূল্যে যে সুযোগ দিচ্ছেন তা না নিয়ে উল্টো তাকে গালিগালাজ করা হচ্ছে! সত্যি, সেকুলাস, বড়ই বিচিত্র!

ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস ঋণ দিয়ে শান্তি এনেছিলেন বলে শান্তিতে নোবেল পেলেন। অথচ আমরা কি ভেবেছি আমাদের তিন মেয়র বিনা ঋণেই দারিদ্র দূর করে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছেন? জলাবদ্ধতার কারণে সড়ক পারাপারের জন্য নৌ শিল্পের প্রসার ঘটছে, বেকাররা নৌকা চালিয়ে দুটো পয়সা আয় করছে। এছাড়া পঁচা-দুর্গন্ধ পানিতে হাঁটতে গিয়ে চর্মরোগ হলে একদিকে ব্যবসা বাড়ছে ডাক্তারের, আরেক দিকে বাড়ছে ওষুধের বিক্রি। রাস্তায় গাড়ি চলাচল কম হওয়ায় তেল বেঁচে যাচ্ছে আর এতে বেঁচে যাচ্ছে লাখ লাখ ডলার।

জলাবদ্ধতার কারণে যে মশা জন্ম নিচ্ছে তাতে উপকার কী কম হচ্ছে? ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ‍ওষুধ কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে। বাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মশার ভূমিকার কথা আমরা ভুলে গেছি। সুলতান ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তা মেনে নিতে পারেননি দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক । বাংলাকে দিল্লির অধিকারে নিয়ে আসার জন্য টানা একবছর তিনি যুদ্ধ করেছেন। ইলিয়াস শাহ দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গে আশ্রয় নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন বাংলার বর্ষা মৌসুমের। বর্ষা এলেই একদিকে মশার কামড়, আরেকদিকে অঝোর ধারার বৃষ্টিতে দিল্লির সেনারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে শেষ পর্যন্ত ফিরোজ শাহকে সন্ধির মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা মেনে নিতে হয়েছিল।

মেয়রদের কল্যাণে মশার অবাধ বিস্তারে ভবিষ্যতে এডিস মশাকেই আমরা ভয়াবহ জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। এতে একদিকে বাঁচবে সমরাস্ত্র ব্যয়, আরেকদিকে কোনো দেশ চাইলে আমাদের কাছ থেকে কিনে নিতে পারবে এই মশা।

শাস্ত্রে আছে ‘গতস্য শোচনা নাস্তিঃ’। আগে যা গেছে ভেবে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং আসুন, আমরা মেয়র মহোদয়দের সমালোচনা বাদ দেই। দেশের স্বার্থে আমরা গলাগলি ধরে বলি –এই বেশ ভালো আছি।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুলাই ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়