ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জন লেনন ও পল ম্যাককার্টনির মিউজিক্যাল ফ্রেন্ডশিপ

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জন লেনন ও পল ম্যাককার্টনির মিউজিক্যাল ফ্রেন্ডশিপ

জন লেনন ও পল ম্যাককার্টনি

এস এম গল্প ইকবাল : অবিশ্বাস্য দুই মেধাবী সংগীত দ্বারা বিশ্বে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাভাবিক জীবন পরিবর্তনের ধকল ও সীমাহীন জনপ্রিয়তা তাদের বন্ধুত্বের পরীক্ষা নিত প্রতিনিয়ত। যে কারণে তাদের অধিকাংশ ভক্ত উষ্ণ তর্কে মেতে দুই দলে পৃথক হয়ে যায়। ভক্তকুল দুজনের বন্ধুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়। এই দুই বন্ধুর নাম জন লেনন এবং পল ম্যাককার্টনি।

বিভিন্ন ওয়েবসাইট, পুস্তক এবং চিত্রকর্মে ১৯৫৭ সালের ৬ জুলাই সংগীত ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এ দিন জন লেননের সাথে পল ম্যাককার্টনির প্রথম পরিচয় হয় পারস্পরিক বন্ধু ইভান ভনের মাধ্যমে। ১৫ বছরের পলের সাথে স্কিফল ব্যান্ড দলের প্রধান গায়ক জনের এই পরিচয় চার্চ ফেয়ারে একটি সংগীতানুষ্ঠানে। দুজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা তৎক্ষণাৎ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৫ বছরের পল এডি ককরান 'টুয়েন্টি ফ্লাইট রক' গেয়ে ১৭ বছরের জনকে মুগ্ধ করেন। জনের গিটার বাজানোর ব্যাপারে শুধু প্রাথমিক জ্ঞান ছিল এবং রক এন রোলের সঠিক লিরিক সম্পর্কে তিনি জানতেন না। তা সত্ত্বেও জ্ঞানসমৃদ্ধ পলকে দলে ভেড়াতে তার দ্বিধা ছিল।

সংগীতের বাইরে দুজনের জীবনে কিছু মিল ছিল। জনের মা মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন। তারও আগে পলের মা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যান। তারা সম্ভবত তাদের শোক একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করত না। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞের মতে শোকের এ অভিজ্ঞতা তাদের বন্ধন আরো দৃঢ় করে।

তিন মাস পর পল কোয়ারিমেন বা স্কিফল ব্যান্ড দলের সাথে প্রথম পারফর্ম করেন। তিনি সবচেয়ে সফল মিউজিশিয়ান হয়েছিলেন, যদিও একক লিড গিটার বাজাতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। কাঁচুমাচু হয়ে তিনি তার প্রথম লিখিত গান ‘আই লস্ট মাই লিটল গার্ল’ এর লিরিক জনকে দেখান। জন পছন্দ করেন এবং নিজের লেখা কিছু গান পলকে দেখান। পরে তিনি জেরি লেইবার এবং মাইক স্টোলারের জুটিতে অণুপ্রাণিত হয়ে পলকে প্রস্তাব দেন যে, তারা যা লিখবে সব ‘লেনন-ম্যাককার্টনি’র নামে প্রকাশিত হবে। অর্থাৎ এতে দুজনেরই কৃতিত্ব থাকবে। যদিও সেই সৃজনশীলতায় একসাথে দুজনের অবদান থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। বিটলসে থাকাকালীন পল ‘অ্যানাদার লেনন-ম্যাককার্টনি অরিজিনাল’ কৃতিত্বে শিট মিউজিক লেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যা সম্ভবত টিন প্যান অ্যালি এবং ব্রডওয়ে দ্বারা অণুপ্রাণিত হয়ে শুরু করেছিলেন।

এক সময় কোয়ারিমেনের নাম পরিবর্তন করে ‘দ্য বিটলস’ রাখা হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে বিটলস পারফর্ম করার জন্য জার্মান স্ট্রিপ ক্লাবে যায়। এ সময় তারা খ্যাতির মধ্য গগণে। বিটলম্যানিয়া তাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে বিচ্যুত করে ফেলে এবং সফলতার আলিঙ্গন দলের অন্য সদস্যদের আরো ঘনিষ্ঠ করে তোলে। ফলে তারা সাক্ষাৎকার, রেকর্ডিং, ভ্রমণ এবং ফিল্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু একটা বিষয়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি- জন এবং পল আগের মতই দলের প্রায় সব গান লিখত। ‘আই ওয়ান্ট টু হোল্ড ইউর হ্যান্ড’ গানটির প্রসঙ্গে লেনন বলেন, এটিতে পল সুর তোলে। আমি তাতে পরিবর্তন এনে তাকে বলি পুনরায় সুর তুলতে। আমরা আমাদের লিরিকে উভয়ে একে অপরের সামনে সুর তুলতাম।

সময়ের স্রোতে পল ও জনের গানে একে অপরের অবদান কমতে থাকে। শ্রোতাদের অজ্ঞাতে জন লেনন-ম্যাককার্টনি অরিজিনালের কিছু লেখা অন্য শিল্পীদের কণ্ঠে হিট হয়, যেমন- বিলি জে ক্রেমার এবং দ্যা ডাকোটাসের ‘আই'ল কিপ ইউ স্যাটিসফায়েড’ এবং ম্যারি হপকিন্সের ‘গুডবাই’ যা পল লিখেছিলেন। পল তার লেখা ও পিটার এবং গর্ডনের গাওয়া ‘উইমেন’ গানটি লেখার কৃতিত্ব ‘বারনার্ড ওয়েব’ নামে প্রকাশ করেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন এতে সফলতার কোনো তারতম্য হয় কিনা। এটিও হিট হয়।

দুই বন্ধুর সম্পর্ক এক সময় কিছুটা বিরূপ হয়। তারা এককভাবে ও নিজের নামে গান রিলিজ করতে শুরু করেন। এ সময় পলের ‘ওব-লা-ডি, ওব-লা-ডা’ এবং ‘পেনি লেন’ ভীষণ সাড়া ফেলে। অপরদিকে জন আত্মকেন্দ্রিক গান ‘আই'ম অনলি স্লিপিং’ এবং ‘নো ওয়েবার ম্যান’ রিলিজ করে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। ম্যাককার্টনিও ব্যক্তিগত বা আত্মকেন্দ্রিক গান (যেমন- ইয়েস্টার ডে) জানতেন এবং লেননও জানতেন কিভাবে আনন্দময় গান (যেমন- গুড মর্নিং, গুড মর্নিং) লিখতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যাককার্টনির গানের কাটতি বেশি ছিল। এ কারণে লেনন তার প্রতি কিছুটা হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করেন। ১৯৬০ সালের দিকে জন পলকে হিংসার আরেকটি কারণ খুঁজে পান। বিভিন্ন নারীর সাথে পলের ডেটিং তার সহ্য হতো না।

তবুও তাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। যদিও পল জানত যে, শ্রোতারা জনের প্রতি কিছুটা বিরূপ। তারপরও তিনি জনের উন্নতি চেয়েছিলেন। জনের প্রতি তার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোভাব ছিল। তবে বিটলসের ভাঙ্গনে তাদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। কয়েকটি কারণে এ ভাঙ্গন ঘটে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, ম্যানেজার ব্রায়ান এপস্টেইনের মৃত্যু এবং প্রতিস্থাপন হিসেবে অ্যালেন ক্লেইনকে নিয়োগ। ম্যাককার্টনি চেয়েছিলেন তার শ্বশুর লি ইস্টম্যানকে দায়িত্বটা দিতে। ১৯৬৭ সালে দলের সদস্য রিঙ্গো দল ছেড়ে দেন। তারপর ছাড়েন জর্জ। ১৯৬৯ সালে লেনন দল ছাড়ার আগে পলকে বলেন, আমি দল ভেঙে দিচ্ছি। আমার কাছে এটেই ভালো মনে হচ্ছে। এটা অনেকটা ডিভোর্সের মতো।

বন্ধুদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে এটা স্বাভাবিক। লেনন ও ম্যাককার্টনিও তার বাইরে ছিলেন না। ১৯৭৪ সালে তারা একসাথে একটি রেকর্ডিংয়ে অংশ নেন। পরের বছর জন পলের অ্যালবাম ‘ভেনাস অ্যান্ড মার্স’-এর রেকর্ডিংয়ে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, আবারো পলের সাথে গান লিখবেন। বিটলসের পুনর্গঠনে তারা চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু পলের ভ্রমণ ও রেকর্ডিং ব্যস্ততা এবং জনের ইমিগ্রেশন সমস্যা তাদের পুনর্মিলনে বাধা দেয়। কিন্তু তারা টেলিফোনে কথা বলতেন।

এক সময় পলের মৃত্যু নিয়ে গুজব ছড়াতে থাকে। অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, পল ১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে কার দুর্ঘটনায় মারা যান এবং তার জায়গায় তারই মতো দেখতে একজনকে প্রতিস্থাপন করা হয়। তার মৃত্যুবিষয়ক গুজব বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গুজবের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল জন এবং পলের সম্পর্ক। এ সময় আরো গুজব ছড়ায় যে, জন বন্ধু পলের মৃত্যুশোকে খুব কাতর হয়ে পড়েছেন, যে কারণে তিনি গানের মাধ্যমে পলের মৃত্যু সম্পর্কিত গোপন সংকেত দেন। এই গুজব মিথ্যা প্রমাণিত হয় পলের এক সাক্ষাৎকারে। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে লাইফ ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।

রাগ, অভিমান, ঝগড়া কিংবা বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও তারা ভালো বন্ধু ছিলেন। ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর জন লেননকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুতে পল বলেন, আমি ভাবতেই পারছি না সে নেই। ...এটা আমার জন্য বড় আঘাত। জন জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারে পল সম্পর্কে বলেন, সে আমার ভাইয়ের মতো। আমি তাকে ভালোবাসি। ...আমাদের বন্ধুত্বে উত্থান-পতন এবং কলহ ছিল। কিন্তু দিন শেষে আমরা বন্ধু। আমি তার জন্য যে কোনো কিছু করতে পারব এবং আমি মনে করি সেও আমার জন্য তাই করবে।
 

 

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়