ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কালের প্রগতিসাধক যতীন সরকার

সঞ্জয় সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৮, ১৮ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কালের প্রগতিসাধক যতীন সরকার

সঞ্জয় সরকার : দেশের একালের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও প্রগতিসাধকের নাম যতীন সরকার। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, সুবক্তা এবং মার্কসবাদে দীক্ষিত সাম্যবাদী তাত্ত্বিক।

সুদীর্ঘকাল মননশীল সাহিত্যচর্চা করছেন তিনি। ১৮ আগস্ট (শুক্রবার) তার ৮২তম জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের এই দিনে বৃহত্তর মমনসিংহের অন্তর্গত নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জ্ঞানের অখণ্ড সাধনায় নিয়ত ব্রতী এ ‘গণশিক্ষক’।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমাজের অন্যতম চিন্তানায়ক যতীন সরকার তার শৈশবেই গ্রহণ করেছিলেন সংস্কৃতি-সাহিত্যের পাঠ। বাংলা অক্ষরগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরপরই ঠাকুরদা রামদয়াল সরকার, বাবা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকার (হোমিও চিকিৎসক) এবং মা বিমলা বালা সরকারসহ পরিবারের অভিভাবকরা তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন অজস্র ‘অপাঠ্য’ পুস্তক। নবীনদের খেলাঘর থেকে টেনে নিয়ে প্রবীণদের পাশে বসিয়ে তাকে শুনিয়েছেন গীতা, রামায়ন, মহাভারত, রামকৃষ্ণ কথামৃত ও স্বামী বিবেকানন্দের জীবনীসহ তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। অভিভাবকদের সৃষ্টি ছাড়া আদর ও মনযোগের অতিরেকের ফলে দারিদ্র্যপীড়িত কৃষক পরিমণ্ডলে থেকেও তিনি বেড়ে ওঠেছিলেন একজন ‘ইঁচড়ে পাকা দার্শনিক’ হিসাবে-যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থে।

প্রাবন্ধিক যতীন সরকারের শৈশব কেটেছে পাকিস্তানের জন্ম-যন্ত্রণার মধ্যে। আবার পাকিস্তান সৃষ্ট যন্ত্রণাভোগের মধ্য দিয়ে কেটেছে তার কৈশোর। মাঝের দিনগুলোতে ঘটে গেছে পঞ্চাশের মন্বন্তর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ছেচল্লিশের সাধারণ নির্বাচন, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনা-দুর্ঘটনা। বলা যায়, জন্মেই এক ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি’ দেখেছেন তিনি। আর এর ভুক্তভোগী তিনি নিজেও। তাই দুঃখ-দৈন্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করেই পাড়ি দিতে হয়েছে তার জীবন চলার পথ। আজকালের শিশু-কিশোরদের মতো নিরুদ্বিগ্ন শিক্ষা জীবন ছিল না তার। লেখাপড়া করতে গিয়ে প্রায় সময় খরচ জোগাতে হয়েছে নিজেকেই। এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন-‘আমার জীবনে সোজা হিসাব সোজাভাবে মেলে না কখনও। অনেক কাটাকুটি, অনেক পাতা নষ্ট হওয়ার পর মেলে। জালাল খাঁর গানের ভাষায়-‘সোজা রাস্তা হয় যে বাঁকা’। জীবনভর আমাকে পা টিপে টিপে থেমে থেমে রাস্তায় চলতে হয়েছে।” আর এসব কষ্টের কারণেই তিনি আজ ‘কষ্টলেখক’। এটিও তারই কথা।

শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি আজ ‘গণশিক্ষক’। ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বিএ পরীক্ষা দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে তিনি দুই মাস কেন্দুয়ার আশুজিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তী দুই বছর (১৯৫৯-১৯৬১) বারহাট্টা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার পর দশমাস গৌরীপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা শেষে ১৯৬৪ সালে যোগ দেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসাবে। চার দশক একাগ্রচিত্তে শিক্ষকতার পর অবসর নেন তিনি। কিন্তু চাকরি থেকে অবসর নিলেও বাস্তব জীবনে কোনো অবসর নেই তার। এখনও তিনি একজন সার্বক্ষণিক কর্মী এবং শিক্ষক। লেখালেখিতে, সভা-সমিতিতে এবং বক্তৃতা-বিতর্কে তিনি আগের মতই ক্লান্তিহীন।

নেত্রকোনার যে এলাকায় তার জন্ম-সে এলাকার লোক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাকে ঋদ্ধ করেছিল নিঃসন্দেহে। নিরক্ষর কৃষক সমাজের পাশে থেকে তাদের ভাবজগৎকে অত্যন্ত মমতার সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে পঠন, পাঠন ও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার ফলেই কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির মন্ত্র- সমাজতন্ত্রকে করে নিয়েছেন জীবনের ধ্রুবতারা। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন তার জীবনের দিকদর্শন। এর প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তার প্রতিটি লেখায় এবং বাস্তব ছুটে চলায়। পঞ্চাশের দশকে মার্কসবাদের যে দীক্ষা নিয়েছিলেন-তা থেকে কখনও বিচ্যুত হননি একচুলও।

‘সংস্কৃতিই মূল। রাজনীতি হচ্ছে সংস্কৃতিতে পৌঁছার উপায় মাত্র’। এ বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ এবং লালন করেন যতীন সরকার। নাসিরাবাদ কলেজে যোগদানের পর ময়মনসিংহের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে তার ছিল সক্রিয় ভূমিকা। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, মুক্তবাতায়ন পাঠচক্র, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ফোরাম, শব্দ আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র, অনুপ্রাস, চরৈবেতি, জলদ প্রভৃতি সংগঠনের সক্রিয় কর্মী, সংগঠক এবং অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ছিলেন দুইবার। রাজনৈতিক সচেতন যতীন সরকার ভাষা আন্দোলনের সময় অজ পাড়াগাঁয় থেকে যেমন মাতৃভাষা রক্ষায় মিছিল-মিটিং-এ অংশ নিয়েছিলেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে ময়মনসিংহে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে সংগঠিত করেছেন পাড়া-মহল্লার মানুষদের। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রতিক্রিয়াশীল রাজাকার-আলবদর গোষ্ঠী বলে বেড়িয়েছে-‘যতীন সরকার ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হলেও তাকে ক্ষমা করা হবে না। কারণ তিনি ক্ষমার অযোগ্য’! বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও দীর্ঘ ১৮ মাস জেল খাটতে হয়েছিল তাকে।

কলেজ জীবনে লেখালেখির সূচনা হলেও যতীন সরকারের লেখা প্রথম পুস্তক প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, পঞ্চাশ বছর বয়সে। প্রথম পুস্তকের নাম ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যশা’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়-‘বাংলাদেশের কবিগান’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও সমাজ চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘রাজনীতি ও দুর্নীতি বিষয়ক কথাবার্তা’, ‘আমদের চিন্তার চর্চার দিক্ দিগন্ত, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভুত ভবিষ্যত’, ভাষা সংস্কৃতি উৎসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’, ‘সত্য যে কঠিন’, ‘বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি’, ‘বাংলা কবিতার মূলধারা এবং নজরুল’, ‘ভাবনার মুক্ত বাতায়ন’, রচনা সমগ্রসহ  (১ম ও ২য় খণ্ড) আরো বেশকিছু জীবনীগ্রন্থ ও সম্পাদিত পুস্তক। ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ নামে একটি তাত্ত্বিক ত্রৈমাসিক সম্পাদনা করতেন তিনি। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য-সবক্ষেত্রেই তিনি এক ক্ষুরধার লেখক। অসামান্য প্রতিভার কারণেই মফস্বলের নিভৃতে পড়ে থাকা সত্ত্বেও সচেতন লোকচক্ষু তাকে এড়িয়ে যায়নি কখনও। স্বাধীনতা পদক(২০১০), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭), বাংলা একাডেমি  প্রদত্ত্ব ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক (১৯৬৭), খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পরস্কার (১৯৯৭), প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই পুরস্কার (২০০৫), মনিরউদ্দিন ইউসুফ স্মৃতি পদক(১৯৯৭), ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব সাহিত্য পদক (২০০১), আলতাব আলী হাসু পুরস্কারসহ  (২০০৯) অসংখ্য পুরস্কার-খ্যাতি পেয়েছেন তিনি।

অবসর গ্রহণের পর শেকড়ের টানে নেত্রকোনায় ফিরে আসেন তিনি। রাজধানী থেকে অনেক দূরের শহর নেত্রকোনার সাতপাই এলাকায় অবস্থিত ‘বানপ্রস্থ’ নামে তার বাসাটি এখন তার সতীর্থ, ছাত্র এবং শিষ্যা-শিষ্যাদের জ্ঞান চর্চাকেন্দ্র। আশি পেরিয়েও ক্লান্তিহীন লিখে যাচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন নবীন লেখক এবং প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্মীদের। ৮২তম জন্মদিনে তার প্রতি আমাদের নিরন্তর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। তিনি ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। তার জ্ঞানের আলোয় আরো  আলোকিত করুন আমাদের। নতুন প্রজন্ম তাকে দেখে ঋদ্ধ হোক, মুগ্ধ হোক।

লেখক : সাংবাদিক ও ছড়াকার।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ আগস্ট ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়