ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দুঃসাহসী এক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২০ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুঃসাহসী এক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট

রুহুল আমিন : বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের ৪৬তম শাহাদতবার্ষিকী আজ।  ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট তিনি দেশমাতৃকার পক্ষে কাজ করতে গিয়ে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ। অসম সাহসিকতাপূর্ণ কর্মের জন্য এ দেশের মানুষের মনে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন মতিউর।

মতিউর রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈতৃক বাড়িতে। তবে তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগরে। যা এখন মতিউরনগর নামে পরিচিত। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। তার বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি।

১৯৬১ সালে তিনি বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে বৈমানিক হিসেবে কমিশন লাভ করেন এবং ডিউটি পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর  করাচির মৌরীপুরে জেট কনভার্সন কোর্স সমাপ্ত করে পেশোয়ারে গিয়ে জেট পাইলট হন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এরপর রিসালপুরে পাঠানো হয় তাকে। রিসালপুরে দুই বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭০-এ করাচি বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধে আসেন।

১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর সপরিবারে দুই মাসের ছুটিতে করাচি থেকে ঢাকা আসেন। ২৫ মার্চের কালরাতে মতিউর ছিলেন রায়পুরের রামনগর গ্রামে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সঙ্গে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলেন। যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন । মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তোলেন একটি প্রতিরোধ বাহিনী। পরে তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিরাট মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান। পাকসেনারা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর-এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ ব্যূহ তৈরি করেন। এর পরই কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গিবিমান দখল এবং সেটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এরপর ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা আসেন এবং ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান ৷ কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল এবং সেটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাকে তখন বিমানের সেফটি অফিসারের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি বিমান দখলের জন্য ২১ বছর বয়সী রাশেদ মিনহা্জ নামে একজন শিক্ষানবীশ পাইলটের উড্ডয়নের দিন (২০ আগস্ট, ১৯৭১) টার্গেট করেন। তার পরিকল্পনা ছিল মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেলে তিনি তার কাছ থেকে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নেবেন। পরিকল্পনা অনুসারে অফিসে এসে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে৷ সামনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩ । পাইলট রাশেদ মিনহাজ বিমানটি নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত একক উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কন্ট্রোল টাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের পর মিনহাজ বিমানটি নিয়ে রানওয়েতে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে মতিউর রহমান সেফটি অফিসারের ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলেন। মিনহাজ বিমানটি থামান এবং ক্যানোপি ( জঙ্গি বিমানের বৈমানিকদের বসার স্থানের উপরের স্বচ্ছ আবরন ) খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান। এ সময় মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর আগে রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল রুমে জানাতে সক্ষম হন তিনিসহ বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে। বিমানটি ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার মিনহাজের বার্তা শুনতে পায় এবং রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও মতিউর রহমান বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডার ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আসার চেষ্টা করেন।

প্রায় ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া অবস্থায় রাশেদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করেন। রাশেদ চাইছিলেন, মতিউর রহমানের বিমান ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সফল হওয়ার চাইতে বিমানটি বিধ্বস্ত করা ভালো ।এ সময় রাশেদের সঙ্গে মতিউরের ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রাশেদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। বিমানটি কম উচ্চতায় উড্ডয়ন করার ফলে একসময় রাশেদসহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমানের সাথে প্যারাসুট না থাকাতে তিনি নিহত হন। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধা মাইল দূরে পাওয়া যায়। সেখান থেকে করাচির মাসরুর বিমানঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের অসীম সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মূল্যায়নস্বরূপ তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৪ জুন তাকে শত্রুভূমি পাকিস্তান থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এনে স্বাধীন বাংলার মাটিতে পুনরায় সমাহিত করা হয় ঢাকার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী সমাধিক্ষেত্রে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ আগস্ট ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়