ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যার হাত ধরে রচিত হয়েছিল এই অঞ্চলের সর্বনাশ

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২৪ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যার হাত ধরে রচিত হয়েছিল এই অঞ্চলের সর্বনাশ

ইংরেজদের কাছে টিপু সুলতানের আত্মসমর্পনের একটি তেলচিত্র। ইনসেটে জব চার্নক। (ছবিগুলো ইন্ডিয়াটাইমস থেকে নেওয়া)

হাসান মাহামুদ : ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আগমন এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় দুশো বছর ঔপনেবিশক রাজত্ব কায়েমের ইতিহাস সবারই জানা। ব্রিটিশদের এই কোম্পানির সঙ্গে জড়িত এই অঞ্চলে বহু লাঞ্চনা, বঞ্চনা ও অত্যাচারের কাহিনী। কিন্তু এসব কাহিনীর সূতিকাগার তৈরি হয় ব্রিটিশদের একজন প্রতিনিধি এবং চতুর কর্মচারীর মাধ্যমে। তিনি জোব চার্নক। যাকে শতাব্দির পর শতাব্দি কলকাতাবাসী ঘৃণা করে হলেও বছরে একবারের জন্য স্মরণ করছে ‘নগরীর স্থপতি’ হিসেবে।

জব চার্নক সপ্তদশ শতকের একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারতবর্ষের কাসিমবাজারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারখানায় জোব চার্নক একজন নিম্নপদস্থ ব্যবসায়ী হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তারপর থেকে শুরু হয় তার চতুরতার কাহিনী।

ভারতবর্ষ কিংবা এই অঞ্চলের বিভিন্ন শহর ও স্থানের প্রথম দিকের ইতিহাস প্রায় সবই লিখেছেন বিদেশি ইতিহাসবিদেরা। এ কারণে বিদেশীরা যুগে যুগে আমাদের শোষণ ও শাসন করেও ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন নায়ক হিসেবে। তেমনি এক সুযোগের নায়কের নাম জব চার্নক। বিদেশি ইতিহাসবিদের কলমে জব চার্নক হয়ে উঠেন কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা। যুগ যুগ ধরে কলকাতাবাসী তাকে ‘কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা’ হিসেবে জেনে এসেছে, মেনে এসেছে। ইতিহাসকে বিকৃত করেই এই জব চার্নককে কলকাতার জনক বলা হতো ।

আজ থেকে ৩২৭ বছর আগে ১৬৯০ সালের আজকের দিনে (২৪ আগস্ট) কলকাতার মাটিতে পা রেখেছিলেন জব চার্নক। সেই দিনটিই পালিত হয়ে আসছে কলকাতার জন্মদিন হিসেবে। তবে ২০০৩ সালে কলকাতা উচ্চন্যায়ালয় এক ঐতিহাসিক আদেশে এই তথ্য ভুল ঘোষণা করেন।

কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক গৌতম বসুমল্লিক এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত বলেছিলেন, ‘কলকাতা যে কেবল ভুলে ভরা।’ কথাটা যে কতটা সত্যি তা বোঝা যায় কলকাতার ইতিহাস জানতে গেলে।

জব চার্নকের পূর্ব-জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। যতদূর জানা যায়, ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কশায়ারের জনৈক রিচার্ড চার্নকের দ্বিতীয় পুত্র জব চার্নকের জন্ম ১৬৩০ সালে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে ১৬৫৬ সালে ২৬ বছর বয়সে তিনি ভারতে আসেন। কিছুদিন পরে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কশিমবাজার কুঠিতে যোগ দেন। বেতন বার্ষিক কুড়ি পাউন্ড। এরপর হুগলি, বালেশ্বর প্রভৃতি জায়গায় কিছুদিন কাজ করে পাটনায় আসেন। সেখানে প্রায় কুড়ি বছর থাকেন এবং পাটনা কুঠির অধ্যক্ষও হন। ১৬৮১ সালে তিনি আসেন কাশিমবাজার রেশম-চালান কুঠির অধ্যক্ষ হয়ে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন থাকতে পারলেন না। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের টাকাপয়সা আত্মসাৎ ও নারীঘটিত কেলেঙ্কারীতে ফেঁসে গিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিলেন হুগলি কুঠিতে। সেখানে গিয়ে কিন্তু তার ভাগ্য খুলে গেল।

১৬৮৬ সালের এপ্রিল মাসে চার্নক পর পর দু’জনকে টপকে একেবারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার এজেন্ট নিযুক্ত হলেন। সেই সময় বাংলার মুঘল সুবাদার ছিলেন শায়েস্তা খাঁ। তাঁর সঙ্গে নানা কারণে ইংরেজদের বনিবনা হচ্ছিল না। বদমেজাজী চার্নকও বিরোধে জড়িয়ে পড়লেন সেখানে। ওই বছরের অক্টোবরে চার্নক হুগলির মুঘল সুবাদারের আড়তের উপর গোলা বর্ষণ করে আগুন লাগিয়ে দিলেন। ভারতের ইতিহাসে মুঘলদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সেই প্রথম অস্ত্রধারণ এবং সেটার সূচনা জোব চার্নকের হাতেই।

প্রাথমিক ভাবে জিতলেও চার্নক জানতেন মুঘলরা প্রত্যাঘাত করবেই। তাই তিনি বেশি দিন আর হুগলিতে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। মাস দুয়েক পর, হুগলির বাস উঠিয়ে পুরো বাহিনী নিয়ে হুগলির পূর্ব পাড়ে সুতানুটি নামের আপাত-নির্জন একটা গ্রাম চোখে পড়লে সেখানেই ঘাঁটি গাড়েন। জোব চার্নকের সেই প্রথম সুতানুটি গ্রামে পদার্পন। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন থাকতে পারলেন না। আবার মুঘলদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে সুতানুটি ত্যাগ করে পুরো বাহিনী নিয়ে চলে যেতে হল।

ইংরেজ ছাড়াও পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, গ্রিক, ফরাসি বণিকরাও তখন পূর্বভারতের বিভিন্ন জায়গায় বাণিজ্য করছে কিন্তু ইংরেজদের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ওই সব বণিকদের বাণিজ্যের থেকে অনেক বেশি। ইংরেজরা চলে যাওয়ায় সুবা বাংলার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমে গেল অনেকখানি। রাজকোষের টাকা জোগান এবং সুবাদারের নিজের রোজগারের তাগিদেই শায়েস্তা খাঁ আবার ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানালেন বাংলায়। এক বছর পর, ১৬৮৭ সালের নভেম্বরে চার্নক আবার সুতানুটিতে ফিরে এসে কুঠি বসালেন।

ইংরেজরা আবার সুতানুটিতে ফিরে এল বটে কিন্তু দ্বিতীয় বারের এই আগমনও স্থায়ী হল না। বদমেজাজী চার্নক তুচ্ছ কারণে বার বার শয়েস্তা খাঁর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন। এতে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে দেখে কোম্পানির কর্তারা ক্যাপ্টেন হিককে পাঠালেন। হিক প্রথমেই সুতানুটি থেকে কুঠিসহ পুরো নৌবহর চট্টগ্রামে নিয়ে গেলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার মুঘল এবং আরাকানদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কিন্তু উভয় পক্ষই হিথের বদ মতলব বুঝতে পেরে তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দিল না। অগত্যা হিথ পুরো বাহিনী নিয়ে একেবারে মাদ্রাজে চলে গেলেন।

দিল্লির সিংহাসনে তখন রয়েছেন বাদশাহ আওরঙ্গজেব। ইংরেজরা বাংলা থেকে পাকাপাকি ব্যবসা তুলে নিয়ে যাওয়ায় তার টনক নড়লো। তিনি খোঁজ নিয়ে সব জানলেন এবং ইব্রাহিম খাঁ নামে এক সৎ লোককে বাংলার সুবাদার করে পাঠালেন। উদ্দেশ্য, ইংরেজদের আবার বাংলায় ফিরিয়ে আনা। ১৬৯০ সালের ২৩ এপ্রিল  এক আদেশনামায় আওরাঙ্গজেব বার্ষিক তিন হাজার টাকা শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের বাংলায় বাণিজ্যের অনুমতি দিলেন। ইব্রাহিম খাঁর আমন্ত্রণে জব চার্নক আবার ফিরে আসেন তার পুরনো জায়গায়। সুতানুটিতে জব চার্নকের এই তৃতীয় পদার্পনের তারিখটিই ২৪ আগস্ট। ইংরেজরা তো বটেই অনেক দেশীয় ইতিহাসবিদও ওই তারিখটিকেই কলকাতা শহরের ‘জন্মদিন’ বলে এসেছেন।

মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬১২ সালে ভারতে প্রথম তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। কিন্তু সুচতুর জব চার্নক এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের বাণিজ্য প্রসার এবং সাম্রাজ্য স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে যান। এর পরের কাহিনী সবার জানা। ১৭০৭ সালে ব্রিটিশদের কঠোর নীতির কারণে মুঘলদের ক্ষমতা হ্রাস পায়। ১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক পলাশী যুদ্ধে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার থেকে শুরু হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন।

এরপর থেকে তারা ক্রমশ নিজেদের এলাকার বিস্তার ঘটায়। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষের সমস্ত সম্পত্তিকে ব্রিটিশ রাজ্যের সম্পত্তি হিসেবে অধিভুক্ত করা হয়। ভারতবর্ষ তিন ধাপে ব্রিটিশ শাসকদের মাধ্যমে শাসিত হয়। ১. কোম্পানি ও দেশিয় নবাবের দ্বৈত শাসন (১৭৫৭-১৭৭০), ২. কোম্পানি শাসন (১৭৭০-১৮৫৮) এবং ৩. ব্রিটিশ রাজের শাসন (১৮৫৮-১৯৪৭)।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের অবসান হলে ‘ভারত সরকার আইন ১৮৫৮’ পাশের মাধ্যমে কোম্পানি শাসনের অবসান হয়। এরপর থেকে ভারতবর্ষ সরাসরি ব্রিটিশ রাজের অধীনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কলোনি হিসেবে শাসিত হয়। ১৮৭৬ সালে একে সরকারিভাবে ভারত সাম্রাজ্য (Empire of India) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়