ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমার কার্টুনিস্ট হয়ে ওঠা || আহসান হাবীব

আহসান হাবীব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১১, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমার কার্টুনিস্ট হয়ে ওঠা || আহসান হাবীব

মা আয়েশা ফয়েজের সঙ্গে আহসান হাবীব

আমাকে কেউ যখন প্রশ্ন করে, আপনি কী করেন?

আমি বলি, আমি কার্টুনিস্ট।

ও কার্টুন আঁকেন!

হ্যাঁ, কার্টুনিস্ট যখন, তখন কার্টুন আঁকতেই হয়।

আর কী করেন? এই প্রশ্ন শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়! কেন বাপ? একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার যখন বলে, সে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার তখন কি তাদের আবার আমরা প্রশ্ন করি- আর কী করেন?

কার্টুনিস্ট এখন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের মতোই একটা পেশা। (অবশ্য আজকাল আর কেউ কার্টুনিস্ট শোনার পর আর সেভাবে বলে না- আর কী করেন?) তবে আগে যখন এই প্রশ্নটা করত তখন আমি বিরক্ত হয়ে বলতাম, সারাদিন যে কার্টুনগুলো আঁকি সেগুলো আবার ইরেজার দিয়ে বসে বসে মুছি।

এবার প্রশ্নকর্তা হতভম্ব হয়ে বলেন, এ্যাঁ! সব মুছে ফেলেন?

হ্যাঁ।

তাহলে কার্টুন এঁকে লাভ কী?

কোনো লাভ নেই। আমি হতাশ হওয়ার ভঙ্গি করি।


হ্যাঁ, সত্যি কথা বলতে কি এভাবেই নানা জনকে নানা সত্য-মিথ্যা কৈফিয়ত দিয়ে আমার কার্টুনিস্ট জীবন চলছে। তবে না, আমি আমার কার্টুনিস্ট জীবন নিয়ে মোটেই হতাশ নই। যথেষ্ট এনজয় করি। আরো ভালো লাগে যখন দেখি, আমার আশপাশে তরুণরা কার্টুনিস্ট হয়ে উঠছে নিজেদের আগ্রহেই। শুধু কার্টুনিস্টই হচ্ছে না, দেশ-বিদেশ থেকে দিব্যি মূল্যবান সব পুরস্কার জিতে নিয়ে আসছে।

এইতো কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। ‘বিস্তার’ নামে সেখানকার একটি আর্ট কমপ্লেক্সের আমন্ত্রণে। কার্টুন আঁকার ওপর একটা ওয়ার্কশপ ছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন আরেক বিখ্যাত পেইন্টার কাম কার্টুনিস্ট রেনবী (রেজাউন্নবী, রনবীর ভাই) আমরা দুজন মিলে চট্টগ্রামের কিছু তরুণ-তরুণীকে কার্টুন সম্পর্কে ধারণা দিলাম। নানা টিপস দিলাম। ওয়ার্কশপের এক পর্যায়ে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে আমাদের একটা বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল। ছাত্রদের ক্রিয়েটিভ কাজে উদ্বুদ্ধ করার মতো করে কিছু বলা আরকি। সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি বিশাল হল রুমে সাড়ে তিনশ ছাত্র মূর্তির মতো বসে আছে। কড়া নিয়মের মধ্যে তারা থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা সেভাবেই বেড়ে উঠছে। আমি কার্টুন নিয়ে কথা বলার পর আমার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বললাম, আচ্ছা তোমরা তো বড় হয়ে কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ গবেষক হবে, কেউবা আর্মি  অফিসার হবে। তোমাদের মধ্যে কেউ কি কার্টুনিস্ট হতে চাও?

সমস্ত হলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। তাহলে কেউ কার্টুনিস্ট হতে চাও না? আমি আবার বলি। ঠিক তখন সামনের সারির বাচ্চা একটা ছেলে সম্ভবত সেভেনে পড়ে, সে হাত তুলে জানাল, সে কার্টুনিস্ট হতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে আরেক পাশ থেকে আরেকটা বাচ্চা ছেলে হাত তুলল; সেও সেভেনে বা এইটে পড়ে (নিচু ক্লাশের ছাত্ররা সামনের সারিতে বসেছে)। সেও কার্টুনিস্ট হতে চায়। সত্যি সেই মুহূর্তে আমার বুকটা ভরে গেল। আমি আমার কার্টুনিস্ট জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছি বটে সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, একজন কার্টুনিস্টের জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কি হতে পারে? এর কাছে আমার সব আন্তর্জাতিক পুরস্কার ম্লান হয়ে গেল।


এবার শোনা যাক আমার কার্টুনিস্ট হয়ে ওঠার গল্প। এই গল্প আসলে খুব সাধারণ। আমার বাবার কারণে বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের ভাই-বোনদের নানান সৃজনশীল কর্মকাণ্ড করতে হতো। গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা, মাটি দিয়ে পুতুল বানানোর প্রতিযোগিতা... একটা না একটা লেগেই ছিল বাসায়। সেই কারণেই হয়ত আমাদের বাসায় আমরা ভাইবোনেরা সবাই কমবেশি ছবি আঁকতে পারি। লিখতেও পারি। একটা ঘটনা মনে পড়লে এখন আমার বেশ হাসি পায়, বাবার জন্য মায়াও লাগে। বাবা একবার ঘোষণা দিলেন, গল্প লিখে জমা দিলে চারআনা পাওয়া যাবে (এরকম প্রায়ই করতেন তিনি)। আমি তৎক্ষনাত গল্প লিখে ফেললাম- সচিত্র গল্প। মনে আছে বাবা তখন অফিস থেকে ফিরে এসে গরমের দিন বলে মাটিতে পাটি পেতে আরাম করে ঘুমাচ্ছিলেন। আমি গিয়ে বাবাকে ডাকলাম, আব্বা আব্বা...

হু। বাবা ঘুম ঘুম চোখেই বললেন।

গল্প লিখেছি।

পড়ে শোনা।

আমি বাবার কানের কাছে বিরবির করে পড়ে শুনালাম। বাবা ঘুম ঘুম চোখেই বললেন, সুন্দর হয়েছে।

গল্পে ছবিও আছে, এই যে... আমি ডায়েরির পাতা খুলে বাবাকে দেখানোর চেষ্টা করলাম। বাবা ঘুম ঘুম চোখেই কোনোমতে এক চোখ খুলে বললেন, সুন্দর হয়েছে। 

পাশেই মা শুয়ে ছিলেন। তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখছিস না তোর বাবা ঘুমাচ্ছে।

আমি নাছোড়বান্দা হয়ে বাবার কানের কাছে গিয়ে বললাম, চারআনা পয়সা দিবেন বললেন যে। বাবা এবার মাকে বললেন, আয়েশা ওকে চারআনা পয়সা দিয়ে দাও। মা মহা বিরক্ত হয়ে আঁচলে বাধা চারআনা পয়সা দিয়ে তার লেখক ও শিল্পী পুত্রকে কোনোমতে বিদায় করলেন। আমি তখন এক ছুটে বাইরে... চার আনায় তখন পুরো দুনিয়াটাই যেন কিনে ফেলা যেত!

 

কার্টুন: আহসান হাবীব

পরবর্তীতে বড় ভাই যখন মহসীন হলে থাকত তার সাথে চিঠিপত্র চালাচালি ছিল। মায়ের কড়া নির্দেশ- ছেলেটা একা একা ঢাকায় হলে থাকে, ওকে সবাই চিঠি লিখবি। আমি মায়ের হুকুম পালন করে তাকে সবসময় সচিত্র চিঠি লিখতাম। তার জবাবে সেও ছবি এঁকে চিঠির উত্তর দিত। এখন মনে পড়ছে সে যা এঁকে পাঠাত সেগুলো সবই ছিল চমৎকার সব কার্টুন টাইপ ছবি।

এরপর যখন আরেকটু বড় হলাম দেখি আমার মেজ ভাই সে কমিকস আঁকে আবার কার্টুনও আঁকে। সেগুলো ছাপা হয় পত্রিকায়। আমি তৎক্ষনাত সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার কার্টুনও ছাপা হতেই হবে। কিন্তু কে ছাপবে আমার কার্টুন?  তাছাড়া সেগুলো আদৌ কার্টুন হচ্ছে কিনা সেটাও তো বুঝতে হবে। শেষে মেজ ভাইকে দেখালাম। সে বলল, আঁকা খারাপ না কিন্তু নিজের আইডিয়ায় আঁকতে হবে। অন্যের ধার করা আইডিয়া নিয়ে আঁকলে চলবে না। শেষ পর্যন্ত নিজের আইডিয়ায় কমিকস আঁকা শুরু করলাম। প্রথমে আঁকলাম ছোট ছোট কমিকস স্ট্রিপ। সেগুলো অবজারভারের ছোটদের একটা পাতায় ছাপা হতে শুরু করল। এমন না যে আমার অঙ্কন প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে সেগুলো সম্পাদক আঙ্কেল কিম ছাপতে শুরু করেছেন। দরখাস্ত করে আঙ্কেল কিম-এর পাতার মেম্বার হলে তার আঁকা বা লেখা ছাপা হতে শুরু করে। তখন অবশ্য নামের পাশে মেম্বারশিপ নাম্বারটাও থাকতো।


এই করতে করতে একদিন আমার এক পাতা কার্টুন ছাপা হলো শিশু একাডেমির ‘শিশু’ পত্রিকায়। আমাকে বিল নিতে ডাকা হলো। আমার নামে পঁচিশ টাকা বিল হয়েছে... কি জ্বালা কার্টুন এঁকে বিল! তাও আবার পঁচিশ টাকা!! গেলাম আনতে। গিয়ে দেখি সম্পাদকের সামনের এক চেয়ারে সাদা চুল সৌম্য দর্শন এক ভদ্রলোক বসে আছেন। তিনি আমার নাম আহসান হাবীব শুনে একটু আহত হলেন বলে মনে হলো। পরে জানতে পেরেছি তিনি আর কেউ নন বিখ্যাত কবি আহসান হাবীব। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেই স্কুলে আমিও ছাত্র ছিলাম।

তারপর ঢাকা শহরের শত শত ড্রেন দিয়ে গ্যালন গ্যালন পানি গিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়েছে। কবি জীবনানন্দের ভাষায় ‘নক্ষত্রের বেগে ছুটেছে সময়’। সেই সময় একদিন ১৯৭৮ সালের মে মাসে প্রকাশিত হলো ‘উন্মাদ’। দেশের প্রথম কার্টুন পত্রিকা। সেই প্রকাশনা এখনো চলছে চল্লিশ বছর হতে চলল, আমি এখনো তার সম্পাদক-প্রকাশক (যেহেতু অন্য কেউ এই দায়িত্ব নিতে রাজী না)। তবে সেই সময়টায় অবশ্য আরো কিছু কার্টুন পত্রিকা বের হয়েছিল। যেমন ‘কার্টুন’ সম্পাদক হারুনুর রশীদ হারুন (প্রবাসী), ‘লোকজন কার্টুন’ সম্পাদক রেজাউন্নবী, ‘আঙ্গুল’ সম্পাদক জাকির হোসেন সেলিম, ‘ব্যাঙএঙ' সম্পাদক মামুন রিয়াজী (প্রবাসী), ‘বিচ্ছু’ সম্পাদক মহিবুল আলম (প্রবাসী), ‘চাবুক’ সম্পাদক ইব্রাহীম মন্ডল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে রইল আমাদের উন্মাদ ...সারভাইবেল অফ দ্য ফিটেস্ট!


হ্যাঁ উন্মাদকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে অনেক তরুণ কার্টুনিস্ট। তারা এখন প্রতিষ্ঠিত। তাদের ঘিরে তৈরি হচ্ছে আরো সব নতুন নতুন শিক্ষানবীশ কার্টুনিস্ট। এ যেন কার্টুনের এক মহা চক্র। এই চক্রের পাকে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়- নাহ্ খুব ভুল কি করেছি কার্টুনিস্ট হয়ে? মনে হয় না। বরং শেষে একটা জোক বলি। রিয়েল লাইফ জোক।  আরেকজন কার্টুনিস্টের জীবন থেকে নেয়া এই রিয়েল লাইফ জোক।

বিদেশী এক আর্কিটেক্ট। হঠাৎ পেশা বদল করে কার্টুনিস্ট হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে তাকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করল, আপনি হঠাৎ আর্কিটেক্ট থেকে কার্টুনিস্ট হলেন যে?

কারণ আর্কিটেক্ট হিসেবে আমি ব্যর্থ।

তাহলে নিশ্চয়ই কার্টুনিস্ট হিসেবে সফল?

না, এখানেও ব্যর্থ।

তাহলে এখনো কার্টুন আঁকছেন কেন?

কী করব? বাই দিস টাইম, আমি কার্টুনিস্ট হিসেবে ফেমাস হয়ে গেছি যে!



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়