ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

তিনি ছিলেন পন্ডিত রামশংকরেরও গুরু

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তিনি ছিলেন পন্ডিত রামশংকরেরও গুরু

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

শাহ মতিন টিপু : ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ  মাইহার ঘরানার প্রবর্তনের কারণে সঙ্গীত জগতে বিখ্যাত হয়ে আছেন ।যা আলাউদ্দিন ঘরানা নামেও পরিচিত। সেতার ও সরোদ বাদনে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। কিংবদন্তিতুল্য এই সঙ্গীত সাধকের ৪৬তম প্রয়াণ দিবস আজ।

তিনি ভারতের মধ্যপ্রদেশের মাইহারে ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সঙ্গীতশিল্পী পরিবারে আনুমানিক ১৮৬২ সালের এপ্রিলে । তার পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন ।

শৈশবেই সুরের প্রতি ছিল তার অমোঘ আকর্ষণ। সুরের সন্ধানে মাত্র ১০ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এক যাত্রাদলের সাথে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। ওই সময় তিনি জারি সারি বাউল ভাটিয়ালি কীর্তন পাঁচালি এসব বিচিত্র গানের সাথে পরিচিত হন।

চলে যান কলকাতা । ১২ বছর একনাগাড়ে সঙ্গীত সাধনার শর্তে প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । সাত বছরের শেষ দিকে হঠাৎ মারা যান এই সঙ্গীত গুরু। এতে শোকে পাথর হয়ে যান আলাউদ্দিন খাঁ । অকস্মাৎ কণ্ঠসঙ্গীত ছেড়ে দিয়ে নিমগ্ন হন যন্ত্রসঙ্গীত সাধনায় । এরপর তিনি বাঁশি পিকলু সেতার ম্যাডোলিন ব্যাঞ্জু ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সেই সঙ্গে তিনি পাশ্চাত্য রীতিতে এবং দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। এ ছাড়া মৃদঙ্গ ও তবলা শেখেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্য বিশারদ হয়ে ওঠেন।

আলাউদ্দিন খাঁ কিছু দিন ছদ্মনামে মিনার্ভা থিয়েটারে তবলা বাদকের চাকরি করেন। এরপর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগৎ কিশোর আচার্যের আমন্ত্রণে তার দরবারে সঙ্গীত পরিবেশন করতে যান। সেখানে ভারতের বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁর সরোদ বাদন শুনে তিনি সরোদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার কাছে পাঁচ বছর সরোদে তালিম নেন। এরপর ভারতখ্যাত তানসেন বংশীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে সরোদ শেখার জন্য তিনি রামপুর যান। আলাউদ্দিন খাঁ তার কাছে দীর্ঘ ৩০ বছর সঙ্গীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সূক্ষ্ম কলাকৌশল আয়ত্ত করেন।

১৯১৮সালে ভারতের মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের সঙ্গীতগুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করেন। ফলে  মাইহারে তার বসবাস স্থায়ী হয়ে যায়। বেরিলির পীরের প্রভাবে তিনি যোগ, প্রাণায়াম ও ধ্যান শেখেন। আসলে জীবনের একটা বড় অংশই তিনি শিক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন।

১৯৩৫ সালে তিনি নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সাথে বিশ্বের অনেক দেশ সফর করেন। তিনিই ভারতীয় উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে পরিচিত করান।  উদয় শঙ্কর পরিচালিত নৃত্যভিত্তিক ‘কল্পনা’নামের একটি ক্ল্যাসিক সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে এতটাই বিশেষত্ব অর্জন করেছিলেন যে, সহজাত প্রতিভাগুণে তিনি সরোদ বাদনে ‘দিরি দিরি’ সুরক্ষেপণের পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণপদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতারে সরোদের বাদন প্রণালী প্রয়োগ করে সেতার বাদনেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সঙ্গীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন।

আলাউদ্দিন খাঁ কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্রেরও উদ্ভাবক। সেগুলোর মধ্যে ‘চন্দ্র সারং’ ও ‘সুর শৃঙ্খার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক রাগ-রাগিনীও সৃষ্টি করেন। যেমন- হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, মেহ-বেহাগ, মদন মঞ্জুরী, মোহাম্মদ (আরাধনা), মানঝ খাম্বাজ, ধবল শ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চণ্ডিকা, দীপিকা, মলয়া, কেদার, ভুবনেশ্বরী প্রভৃতি । তিনি দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে অর্কেস্টার স্টাইলে একটি যন্ত্রিদল গঠন করে নাম দেন ‘রামপুর স্ট্রিং ব্যান্ড’।

ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতের সঙ্গীত আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৫৪ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক প্রথম সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’ ও ১৯৭১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ১৯৬১ সালে তিনি বিশ্বভারতী কর্তৃক ‘দেশীকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। ভারতের দিল্লি ও বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আজীবন সদস্যপদ দান করেন।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত রবি শংকরের মতো পন্ডিতেরও গুরু। বিখ্যাত নিখিল ব্যানার্জী ও পান্নালাল ঘোষও তার শিষ্য ।তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিতি ও প্রচার করেন। তিনি ছিলেন অতি উচ্চমাত্রার সঙ্গীতকলাকার। সঙ্গীতজগতের এক দিকপাল সাধক।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়