ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বোদ্ধামহলে গান শুনিয়ে আজকের ফিরোজা বেগম

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৫, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বোদ্ধামহলে গান শুনিয়ে আজকের ফিরোজা বেগম

এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় নজরুলের সান্নিধ্যে ফিরোজা বেগম

রাহাত সাইফুল: এক  গ্রীষ্মের ছুটিতে ছোট মামা আর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে তিনি গেলেন কলকাতা। মামার উৎসাহে বোদ্ধামহলে গান শোনাতে লাগলেন। ছোট্ট মেয়েটার গায়কীতে মুগ্ধ সবাই। একদিন গুণীজনদের মজলিশে গান শুনিয়ে দারুণ তারিফ পেলেন। তাকে আদর করে পাশে বসালেন লম্বা চুলের এক ভদ্রলোক। গান শুনে জানতে চাইলেন, ‘এ গান তুমি শিখলে কেমন করে?’ তিনি জানালেন, ‘কালো কালো রেকর্ড শুনে নিজে নিজেই শিখেছি।’

শুনে সবাই অবাক! বাসায় ফিরে মামা জানালেন, আসরের মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিই কথা বলেছিলেন তার সঙ্গে। এভাবেই তিনি নজরুলকে চিনলেন। বলছি, ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত নজরুল সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের কথা। নজরুলের গান গেয়ে সম্রাজ্ঞী উপাধিও পেয়েছেন তিনি।

তখন চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী ফিরোজা। গানের ভিড়ে নিজেকে আলাদা করে নেয়ার এক তীব্র ইচ্ছা কাজ করে তার মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলেন অন্য গান নয়, তিনি শুধু নজরুলের গানই গাইবেন। নজরুলসংগীতই হয়ে উঠল তার ধ্যান ও জ্ঞান। বিষয়টি তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন। তখন নজরুলসংগীত বলা হতো না। বলা হতো আধুনিক গান, লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মূলত ফিরোজা বেগমের চেষ্টাতেই তা পায় নজরুলগীতির অভিধা। তার অনড় ভূমিকার কারণে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে এক সময় নজরুলের গান নিয়মিত বাজানো হতো।

১৯৪৮-৪৯ সালে ফিরোজা বেগম আর তালাত মাহমুদকে অতিথি শিল্পী হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তাদের গানেই উদ্বোধন করা হয় ঢাকা রেডিওর শর্ট ওয়েভ। ১৯৬৮-৬৯ সালে ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধন হবে। গান গাইতে ডাক পড়ল ফিরোজা বেগমের। তিনি জানালেন, আগে বাংলা গান গাইতে দিতে হবে, না হলে গাইবেন না। তখনকার তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ওই শর্তে রাজি হন। সেই অনুষ্ঠানে ফিরোজা বেগম গাইলেন- ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’।

সত্তরে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠেছে স্বাধিকার আন্দোলনে। সে সময় করাচিতে ইএমআই পাকিস্তানে তিনি ‘জয়, জয়, জয় বাংলার জয়’ আর ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ এই বাংলা গানগুলো রেকর্ড করেন। এই গান গাওয়ার অপরাধে হেনস্তার মুখোমুখিও হতে হয় তাকে। দেশে ফেরার পর একদিন রেডিও স্টেশন থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর রাত ১টায় নামিয়ে দিয়ে যায় বাসায়। তবে গানের মূল রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাধিকবার তার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। ১৪ ডিসেম্বর একটুর জন্য বেঁচে যান মৃত্যুর হাত থেকে।
 


নজরুলসংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফিরোজা বেগম দেশে-বিদেশে পেয়েছেন নানা পুরস্কার। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, নেতাজী সুভাষচন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি স্বর্ণপদক, সেরা নজরুলসংগীতশিল্পী পুরস্কার (টানা বেশ কয়েকবার), নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট, এমন আরো অগণন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে পেয়েছেন গোল্ড ডিস্ক। সর্বশেষ ২০১২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘বঙ্গ সম্মান’ পুরস্কার গ্রহণ করেন।

ফিরোজা বেগম ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) রাতইল ঘোনাপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল এবং মা বেগম কওকাবুন্নেসা। শৈশবেই তার সংগীতের প্রতি অনুরাগ জন্মে। ১৯৪২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে ইসলামী গান নিয়ে ফিরোজা বেগমের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত সুরসাধক চিত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে ছোট্ট ফিরোজা গাইলেন ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। এতেই বাজিমাত! বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে সব রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায়। সংগীতপ্রেমীদের সঙ্গে সুরের আকাশের এই তারার সেটাই প্রথম পরিচয়। ছোট্ট মেয়েটির গায়কী সংগীতবোদ্ধা ও সাধারণ শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। ১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি তার গলায় নজরুলের গানের প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করে। ‘আমি গগণ গহনে সন্ধ্যাতারা...’ গেয়েছিলেন তিনি।

১৯৫৪ সাল থেকে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। ফিরোজা বেগমের তিন সন্তান- তাহসিন আহমেদ, হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ। হামিন ও শাফিন- উভয়েই রকব্যান্ড দল মাইলসের সদস্য।১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই কমল দাশগুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন।

২০১৪ সালের আজকের এই দিনে নজরুলসংগীতের স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম সকলকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান না ফেরার দেশে। শরীরে বার্ধক্য এসেছিল, কিডনি জটিলতায়ও ভুগছিলেন। ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে রাত ৮টা ২৮ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রাহাত/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়