ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কাজীর ভাত ও কাজীর নাস্তা

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাজীর ভাত ও কাজীর নাস্তা

কাজীর ভাত

আরিফ সাওন : খিচুড়ির মত, তবে পাতলা করে রান্না। তাতে তেলে ভাজা শুকনো মরিচের গুড়া আর কালো জিরার উপস্থিতি স্পষ্ট।

স্বাদে টক। মনে হচ্ছিলো ডাল, চাল আর তেঁতুল দিয়ে তৈরি খিচুড়ি। কিন্তু না, এটি খিচুড়ি না। এটিই হচ্ছে ‘কাজীর নাস্তা’। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মানুষের অন্যতম শখের খাবার। এলাকাবাসী এই খাবারকে তাদের ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য করেন এবং উৎসবে বা বিশেষ দিন উপলক্ষে তা তৈরি করেন। অতিথি আপ্যায়নেও এই খাবার পরিবেশন করা হয়।

গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমানের বাড়িতে গত ৫ সেপ্টেম্বর (২০১৭ সাল) সকালে এই প্রতিবেদক কাজীর নাস্তা ও কাজীর ভাত নামের সুস্বাদু খাবারের সঙ্গে পরিচিত হন।

মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, এই অঞ্চলের  মানুষের অত্যন্ত প্রিয় খাবার কাজীর নাস্তা এবং কাজীর ভাত। দুটি সম্পূর্ণ আলাদা খাবার এবং বিশেষ বিশেষ দিন, বিশেষ কোন অনুষ্ঠান এমনকি বাড়িতে মেহমানের আগমন উপলক্ষে শখ করে এই খাবার তৈরি করা হয়।

মো. সিদ্দিকুর রহমান আকনের স্ত্রী সাগরিকা রহমান এই দুটি খাবার তৈরিতে অত্যন্ত পটু। তার হাতে তৈরি কাজীর নাস্তা ও কাজীর ভাতের স্বাদের বেশ সুনাম রয়েছে।

সাগরিকা রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাত রান্নার সময় ধোয়া চাল থেকে পরিমাণ মত নিয়ে সে চাল একটি মাটির হাড়িতে পানির মধ্যে রাখা হয়। সেই মাটির হাড়ি চুলার পাশে এমনভাবে বসানো হয় যাতে আগুনের আঁচ মাটির হাড়িতেও লাগে। পাঁচ থেকে ছয় দিন প্রতিবার ভাত রান্নার সময় ধোয়া চাল থেকে পরিমাণ মত নিয়ে সে চাল ওই মাটির হাড়িতে জমানো হয়। সপ্তম দিনে মাটির হাড়ির পানি ফেলে দিয়ে জমে যাওয়া চাল ভালভাবে ধুয়ে ভাত রান্না করা হয়। সেই ভাতই হচ্ছে কাজীর ভাত।’

সাগরিকা রহমান বলেন, ‘সাতদিনে মাটির হাড়িতে জমানো চাল খানিক ফুলে উঠে এবং একটু টক হয়ে যায়। সেটাই খাবারে বাড়তি স্বাদ এনে দেয়। তবে মাটির হাড়িতে ওভাবে জমানো চাল সাতদিনের বেশি রাখা ঠিক নয়। কারণ, সেটা খাওয়ার অনুপযোগী হতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘কাজীর ভাত অনেক প্রকার ভর্তা দিয়েই খাওয়ার রেওয়াজ। এক্ষেত্রে অনেকে ২০ প্রকার ভর্তারও আয়োজন করে থাকেন। এর মধ্যে থাকে ডাল ভর্তা, কচু ভর্তা, শিম ভর্তা, বরবটি ভর্তা, পটল ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ধনেপাতা ভর্তা, কালজিরা ভর্তা, কাকরোল ভর্তা, লাউশাক ভর্তা, শুকনো মরিচ ভর্তা, তিল ভর্তা, সরিষা ভর্তা। মূলত ভর্তা দিয়েই এই ভাত পরিবেশন করা হয়। তবে আজকাল ভর্তার পাশাপাশি যুক্ত হয় ইলিশ মাছ, পুঁটি মাছ, দেশি কই মাছ ভাজা।
 

কাজীর নাস্তা


কাজীর নাস্তা তৈরি সম্পর্কে সাগরিকা রহমান বলেন, ‘এটি কাজীর ভাত তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে আরো কিছু প্রক্রিয়া যুক্ত করে তৈরি করা হয়। কাজীর নাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে মাটির হাড়িতে জমানো চাল দিয়ে সপ্তম দিবসে ভাত রান্নার সময় মাড় গলানো হয়। সেই মাড়ের সাথে পরিমাণ মত পানি মিশিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। এদিকে মাড় গলানোর পর ভাতও আরো প্রক্রিয়ার জন্য রাখা হয়। হাড়িতে পানি মেশানো মাড় ফুটতে শুরু করলে বিভিন্ন ভর্তা সেই হাড়িতে মাড়ের মধ্যে পরিমাণ মত ফেলা হয়। ভর্তা মেশানো মাড় জ্বাল হতে হতে একটা পর্যায়ে এলে আলাদা করে রাখা ভাত তাতে মেশানো হয় এবং আরো জ্বাল দেওয়া হয়। একটু ঘন হয়ে এলে চুলা থেকে হাড়ি নামিয়ে ফেলা হয়। এটাই হলো কাজীর নাস্তা।

সাগরিকা রহমানের মেয়ে সোনিয়া আক্তার ও  ছেলে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, দুটি খাবারই তাদের ‍খুব পছন্দের।

এই বাড়ির মেয়ে অর্পা বলেন, ‘শীতকালে কাজীর ভাত কম তৈরি হয়। কারণ, শীতকালে চাল কাঙ্খিত পর্যায়ে ফুলে উঠতে ও টক হতে সময় বেশি লাগে। এই খাবার তৈরি করা অনেক ঝামেলার কাজ বলে শীতের সময় অনেকে এই খাবার তৈরি করতে চান না।’

অর্পা আরো বলেন, ‘কাজীর নাস্তা খেতে বেশ টক লাগে। আর কাজীর ভাত অতোটা টক স্বাদযুক্ত হয় না। কারণ, ভাতের মাড় ফেলে দেওয়ায় টক কিছুটা চলে যায়।’

অর্পার বড় বোন মৌলি আকন্দ বলেন, ‘সব ভর্তা একসঙ্গে মেখে কাজীর ভাত খাওয়ার রেওয়াজ। সব ভর্তা একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে স্বাদ হয় এক রকম আর প্রত্যেক ভর্তা আলাদা আলাদা মেখে খেলে স্বাদ হয় আরেক রকম। তাই সবাই ভাত-ভর্তা সব একসঙ্গে মেখেই এর স্বাদ নেন।’

মো. সিদ্দিকুর রহমানের জামাতা শেখ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘খাওয়া তো দূরের কথা এর আগে এই খাবারের নামও কখনও শুনিনি। কাজীর ভাত আমার জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা।’

শেখ জসিম উদ্দিনের ছোট ভাই আল মামুন বলেন, ‘এই এলাকায় আত্মীয়তা না হলে এমন খাবারের কথা হয়তো জানাই হতো না। এটি বেশ সুস্বাদু খাবার।’

এদিকে বাগেরহাট, খুলনা, রংপুর, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, ঝিনাইদহ, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়িসহ দেশের অন্তত ৪০টি জেলায় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কাজীর ভাত বা কাজীর নাস্তা নামের খাবারের সঙ্গে পরিচিত নন।
 


তবে এই খাবারের প্রচলন রয়েছে ফরিদপুর, মাদারীপুর ও বরিশালের কিছু কিছু এলাকায় এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকায়। সোনারগাঁওয়ে কাজীর নাস্তা পরিচিত ‘কাঞ্জির জাও’ হিসেবে।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর রাজীব খান বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ফরিদপুর এবং নানার বাড়ি মাদারীপুর। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই আমরা কাজীর ভাতের সঙ্গে পরিচিত। মায়ের কাছে শুনেছি, অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চলে এই খাবারের প্রচলন আছে এবং এটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। আমার মা ৮৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি আমার নানীর কাছে এই খাবার তৈরি করা শিখেছিলেন। সেই হিসেবে বলা যায়, শত বছরেরও বেশি সময় ধরে এই খাবারের প্রচলন রয়েছে।’

আরটিভির সাংবাদিক মাসুদ রানা বলেন, ‘আমি অনেক আগে একবার পিরোজপুরে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে খেয়েছিলাম কাজীর ভাত।’

নারায়ণগঞ্জের ফৌজিয়া আক্তার রুবি  ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের কমেন্টে লিখেছেন, ‘আমার অনেক পছন্দের একটি খাবার। তবে এটাকে নারায়ণগঞ্জে ‘কাঞ্জির জাও’ বলে। আমি ছোটবেলায় ওখানেই (ফরিদপুরে) প্রথম খেয়েছি। রেসিপিটা জানা ছিল না।’

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় থাকেন অভিনেত্রী নবীয়া ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে কখনো এই খাবার তৈরি করিনি তবে খেয়েছি। মাস দুই আগে আমার এক প্রতিবেশী আমার জন্য পাঠিয়েছিলেন।’

‘বাংলাদেশ লোকজ সাংস্কৃতিক গ্রন্থমালা, মাদারীপুর জেলা’ বইয়ের তথ্য সংগ্রাহক সুবল বিশ্বাস বলেন, ‘কোন প্রেক্ষাপটে বা কোন এলাকা থেকে এই খাবারের প্রচলন শুরু তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, সাড়ে তিনশ বছরেরও আগে ভাটার অঞ্চলে (মাদারীপুর, পিরোজপুর, ফরিদপুর অঞ্চল) এই খাবারের প্রচলন শুরু হয়। সেই থেকে বংশ পরম্পরায় তা তৈরি হয়ে আসছে। এর প্রচলন শুধু মুসলিম পরিবারে। খুব মজার খাবার এবং এই এলাকায় অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে তা খাওয়া হয়।’

নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কাজীর অপভ্রংশ শব্দ হচ্ছে কাঁজি। আর কাঁজি শব্দটি এসেছে কাঞ্চিক শব্দ থেকে। এর আদি অর্থ হচ্ছে ‘আমানী’ বা ‘জলভাত’ থেকে প্রস্তুত রস। অর্থাৎ জলে ভিজিয়ে রেখে করা হয় বলে এই খাবারের নাম কাজীর ভাত।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭/সাওন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়