ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জ্যাঠামণির আদর্শে অনুপ্রাণিত ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েরা

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জ্যাঠামণির আদর্শে অনুপ্রাণিত ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েরা

হোমসের প্রাক্তন শিক্ষার্থী যারা মানবসেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখতে চান

 

|| কেএমএ হাসনাত ||

স্বপ্ন অনেকেই দেখেন কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে কারো কারো পক্ষে সম্ভব হয়। তারা নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে অন্যদেরও স্বপ্ন দেখা শেখান। শুধু তাই নয়, সেই স্বপ্ন কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব তার পথও দেখিয়ে দেন।

কুমুদিনী হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা এমনই একজন পথপ্রদর্শক ছিলেন। তাকে ঘিরে আজ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগে গড়ে উঠছে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড। যা অন্যকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। এ ধরনের ছোট ছোট উদ্যোগ হয়ে উঠতে পারে সমাজ বদলের হাতিয়ার। মানুষের মধ্যে মানবিক বোধ জাগ্রত করতে পারে। শুধু অর্থ-সম্পদ নয়, মানুষের পাশে দাঁড়াতে একটি সুন্দর মনেরও প্রয়োজন। আর সুন্দর মনের মানুষগুলোই দিন বদলের পথ দেখায়।

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার যখন মাত্র সাত বছর বয়স তখন মা কুমুদিনী সাহা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। এরপর শুরু হয় তাঁর জীবন সংগ্রাম। কতটা অনিশ্চিত পথ তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে তার বর্ণনা দেয়া সত্যি কষ্টকর। বেঁচে থাকার তাগিদে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। পত্রিকার হকারি থেকে শুরু করে এমন কোনো পেশা নেই, যা তিনি করেননি। বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজলে তিনি মিত্র শক্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে আহত সেনাদের সেবাও করেছেন।
 


যুদ্ধ শেষে ফিরে কিছু দিন রেলওয়ের টিটির চাকরি করেন। মিথ্যা অভিযোগে চাকরি চলে যায়। এ সময় চাকরির জমানো সামান্য টাকায় শুরু করেন কয়লা বিক্রির ব্যবসা। কলকাতায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে কয়লা বিক্রি শুরু করেন। এভাবেই তিনি একসময় বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। তাঁর সততা, কর্মনিষ্ঠা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্পৃহায় নিজেকে নিয়োগ করেন।

নিজের জীবন দিয়ে তিনি অনুভব করেছিলেন সমাজে নারীরা কতটা অসহায়। মাকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখেছেন তিনি। একসময় তাঁর সামনেই মায়ের মৃত্যু হয়। তিনি সে সময় কিছুই করতে পারেননি। কিন্তু পণ করেছিলেন জীবনে বড় হয়ে নারীদের জন্য এমন কিছু করবেন যাতে নারীরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। আর এই স্বপ্ন থেকেই তিনি প্রথমে টাঙ্গাইলের অজপাড়া-গাঁ মির্জাপুরে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কুমুদিনী  হাসপাতাল’।

এরপর ভারতেশ্বরী হোমস, টাঙ্গাইলে কুমুদিনী মহিলা কলেজ, মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা এবং সেবা প্রতিষ্ঠানে দু’হাতে দান করে গেছেন। বর্তমানে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার পরিসর আরো বেড়েছে। নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রণদা বিশ্ববিদ্যালয়, মির্জাপুরে কুমুদিনী মহিলা মেডিক্যাল কলেজ, কুমুদিনী নার্সিং কলেজ।
 


ভারতেশ্বরী হোমস মেয়েদের জন্য অন্যতম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটির মেয়েরা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। যে যেখানে আছেন সবাই নিজ নিজ অবস্থানে খুব ভালো আছেন। ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মানবিকতা। শিক্ষাজীবনে তারা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার মানবসেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তা এখনো ধরে রেখেছেন। তাদের প্রিয় জ্যাঠামণিকে (ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েদের কাছে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ‘জ্যাঠামণি’ হিসেবে পারিচিত) সমাজকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত স্মরণ করছেন। তাদের এ প্রচেষ্টা বহু দিনের হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বদৌলতে দিন দিন বড় হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ব্যাচের মেয়েরা আলাদাভাবে তাদের কাজ করে যাচ্ছেন।

ভারতেশ্বরী  হোমসের ’৮৪ ব্যাচের কয়েকজন ছাত্রী মিলে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গড়ে তুলেছেন একটি বৃদ্ধাশ্রম। বিশাল জায়গাজুড়ে আব্দুল আলী সেবাশ্রম নামের বৃদ্ধাশ্রমটি যারা প্রথমে শুরু করেছিলেন তারা ব্যবস্থাপনার জটিলতার কারণে বেশি দিন চালাতে পারেননি। পরে ভারতেশ্বরী হোমসের কয়েকজন সাবেক ছাত্রী এর দায়িত্ব তুলে নেন। গড়ে তোলেন ‘অরুণাচল ট্রাষ্ট’। ট্রাষ্টি বোর্ডের মোট ১১ জন সদস্য রয়েছেন। ইতোমধ্যে আজীবন সদস্য হয়েছেন ২০ জন। বৃদ্ধাশ্রমে বর্তমানে ১২ জন নারী-পুরুষ রয়েছেন। এদের বেশীর ভাগেরই বয়স ৬০ এর উপর। এ মাসেই আরো ৭ থেকে ৮জন আসার কথা রয়েছে। সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছেন বলে জানালের অরুণাচল ট্রাষ্টের সাধারণ সম্পাদক এবং ভারতেশ্বরী হোমসের ’৮৪ ব্যাচের ছাত্রী ফারহানা হক।

তিনি বলেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় জ্যাঠামণির আদর্শকে সামনে রেখে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। অনেকেরই বৃদ্ধ বয়সে কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। সন্তানরা বাবা-মায়ের পরিচর্যা করেন না। বৃদ্ধ বয়সে সব হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। এটা আমাদের খুব পীড়া দেয়। ভারতেশ্বরী হোমসে পড়ালেখা করার সময় অবহেলিতদের পাশে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা পেয়েছি তাই এখন কাজে লাগাচ্ছি। আমাদের অনেক বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছা আছে। আমাদের লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবোই।     
  


ভারতেশ্বরী হোমসের ’৮৯ ব্যাচের (এসএসসি) ছাত্রী ঊর্মি মোস্তফা রাইজিংবিডিকে বলেন, মেসেঞ্জারে গল্প করতে করতে আজ থেকে এক বছর আগে এই সেপ্টেম্বর মাসে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে তৈরি করেছিলাম একটি গ্রুপ  ‘Homes of hope’। আমরা ঠিক করেছিলাম প্রতি মাসে প্রত্যেকে ৫০০ টাকা করে জমাবো এবং সেই টাকা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে খরচ করবো। আমাদের সেই ছোট্ট গ্রুপ আজ অনেক বড় হয়েছে। প্রথম দিকে ভাবতাম পারবো কিনা, এখন বুঝি আসলে আমাদের ইচ্ছাটাই জরুরি, তারপর বাকি কাজটা এমনিতেই হয়ে যায়। গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা, হইচই- এগুলোর মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই কাজ। এই কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের বন্ধুত্ব আরো অটুট হয়েছে। আমার এই বন্ধুদের জন্য রইল অফুরন্ত ভালোবাসা।

তিনি বলেন, মূলতঃ ১৫জন বন্ধু মিলে এই গ্রুপটা চালাই। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমে আমরা ৯জন সিদ্ধান্ত নেই প্রত্যেকে ৫০০ টাকা করে একটা বিকাশ একাউন্টে জমা করবো। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করা। এই ১ বছরে আমরা ১৫ জন হয়েছি। এখন আমরা ‘জাগো ফাউন্ডেশন’ এর মাধ্যমে দুইজন বাচ্চাকে পড়াই এবং ‘আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে’ একদিনের খাওয়া খরচ দেই। ইতিমধ্যে আমরা একটি গরিব মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু টাকা দিয়েছি ও বৃদ্ধাশ্রমে একটি আলমারি কিনে দিয়েছি। আমরা এখানে আছি - ঊর্মি, শিপ্রা, অমিতা, বৃষ্টি, লুসি, নিপা, স্বপ্না, মুক্তি, জোবেদা, কান্তা, পপি, মিলি, শিমুল, পারভিন এবং রুমা। উল্লেখ্য যে, পারভিন আর রুমা আমেরিকা থেকে টাকা পাঠায়, আর মিলি সিলেট থেকে, শিমুল কুমিল্লা থেকে।

ঊর্মি বলেন, আমরা মুলত আমাদের জ্যাঠামণি ও আমাদের হোমসের শিক্ষকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমরা সবসময় মনে করেছি যে, জ্যাঠামণির আদর্শকে সমুন্নত রাখার দায় আমাদের। কিন্তু পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের সব দায়িত্ব পালন করে বড় পরিসরে সেটা আমরা করতে পারছি না।  তাই জ্যাঠামণির স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমাদের এই ছোট্ট পদক্ষেপ। আশা আছে একদিন এই পদক্ষেপ বড় আকার ধারণ করবে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়