ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শরতের সন্ন্যাসী জীবন!

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৪, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শরতের সন্ন্যাসী জীবন!

হাসান মাহামুদ : বাংলা সাহিত্যে ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ হিসাবে খ্যাত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক এই কথাশিল্পী। তার রয়েছে অসংখ্য বিশেষণ। নারী চরিত্র নির্মাণে তিনি এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অনন্য সাহিত্যিক। অসংখ্য গুণাবলীও ছিল এই মহান পুরুষের। এমনকি এই প্রবাদপুরুষের ছিল সন্ন্যাসী জীবনও।

প্রেমের বিশ্লেষণ, আচার-আচরণের বর্ণনা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন চরিত্রে অন্তর্দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটনো প্রভৃতিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অনন্য। কিন্তু তার সন্ন্যাস জীবনের বিষয়টি খুব বেশি আলোচনায় আসেনি। অথচ, এই সন্ন্যাস জীবনের কারণেই বলা যায়, আজ আমরা জনপ্রিয়তম এই বাঙালি কথাসাহিত্যিককে পেয়েছিলাম। শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যেও প্রচ্ছন্নভাবে ছায়া পড়েছিল তার সন্ন্যাসী জীবনের।

মাত্র কৈশোর পেরুনো শরৎচন্দ্র ভাগলপুর শহরের আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে খেলাধুলা ও অভিনয় করে সময় কাটাতেন। পরে তিনি বনেলী রাজ-এস্টেটে চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু এ সময়ে তিনি পিতার ওপর কোনো কারণে অভিমানবশত সন্ন্যাসী সেজে ঘর ছেড়ে চলে যান। সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন তিনি এবং সন্ন্যাসী সেজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন।

এ সময় একদিন তার পিতার মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন। তথন তিনি মজঃফরপুরে ছিলেন। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তিনি ভাগলপুরে আসেন। পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে ছোটভাই দুটিকে আত্মীয়দের কাছে এবং ছোট বোনটিকে বাড়ির মালিক মহিলাটির কাছে রেখে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। এ সময়ে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন।

কলকাতায় এসে তিনি তার উপেন মামার দাদা কলকাতা হাইকোর্টের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন এবং তার কাছেই ৩০ টাকা মাহিনায় হিন্দি পেপার বুকের ইংরেজি তর্জমা করার একটা চাকরি পান। শরৎচন্দ্র লালমোহনবাবুর বাড়িতে মাস ছয়েক ছিলেন। এরপর এখান থেকে বর্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) চলে যান। বর্মায় গিয়ে লালমোহনবাবুর ভগ্নিপতি রেঙ্গুনের অ্যাডভোকেট অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন।

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন যাওয়ার দু-একদিন আগে কলকাতার বৌবাজারে সুরেন মামা ও গিরীন মামার সঙ্গে দেখা করতে গেলে গিরীন মামার অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গেই একটা গল্প লিখে কুন্তলীন প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু গল্পটিতে নিজের নাম না দিয়ে সুরেনবাবুর নাম দিয়েছিলেন। গল্পটির নাম ‘মন্দির’। দেড়শ গল্পের মধ্যে ‘মন্দির’ সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছিল।

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গেলে কিছুদিন পরে মেসোমশায় অঘোরবাবু বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে তার একটা অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। বছর দুই পরে হঠাৎ অঘোরবাবুর মৃত্যু হয়। তখন তার পরিবারবর্গ রেঙ্গুন ছেড়ে দেশে চলে আসে। এই সময় শরৎচন্দ্রের রেলের অডিট অফিসের চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্র তখন তার রেঙ্গুনের এক বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে পেগুতে যান। পেগু রেঙ্গুন থেকে ৪৫ মাইল উত্তরে। পেগুতে গিয়ে তিনি গিরীনবাবুর বন্ধু অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে অনেক দিন ছিলেন। অবিনাশবাবুর বাড়ি ছিল শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান দেবানন্দপুরের অদূরে বৈদ্যবাটীতে। তাই অবিনাশবাবু সেই বিদেশে শরৎচন্দ্রকে নিজের দেশের লোক হিসাবে খুবই আদর-যত্নে রেখেছিলেন।

অবিনাশবাবুর বাড়িতে থাকাকালে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস একাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রকুমার মিত্রের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের একদিন পরিচয় হয়। শরৎচন্দ্র বেকার থাকায় মণিবাবু নিজের অফিসে তার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। শরৎচন্দ্র এই চাকরি পেয়েই পেগু থেকে রেঙ্গুনে চলে আসেন। এই চাকরি পাওয়ার আগে শরৎচন্দ্র মাঝে নাঙ্গলবিনে কিছুদিন এক ধানের ব্যাবসায়ীর সঙ্গে কাজ করেন। শরৎচন্দ্র মণিবাবুর দেওয়া এই চাকরি প্রায় দশ বছর করেছেন।

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে থাকার সময় বেশির ভাগ সময়টাই থেকেছেন শহরের উপকণ্ঠে বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলে। এখানে শহরের কলকারখানার মিস্ত্রীরাই প্রধানত থাকত। শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতেন। তিনি তাদের চাকরির দরখাস্ত লিখে দিতেন, বিবাদ মিটিয়ে দিতেন, অসুখে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন, বিপদে সাহায্যও করতেন। মিস্ত্রীরা শরৎচন্দ্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করত এবং দাদাঠাকুর বলে ডাকত। শরৎচন্দ্র এদের নিয়ে একটা সঙ্কীর্তনের দলও করেছিলেন।

শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীপল্লীতে থাকার সময় তার বাসার নিচেই চক্রবর্তী উপাধিধারী এক মিস্ত্রী থাকত। ওই মিস্ত্রীর শান্তি নামে একটি কন্যা ছিল। চক্রবর্তী এক প্রৌঢ় ও মদ্যপ মিস্ত্রীর সঙ্গে তার কন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করে। চক্রবর্তীর কন্যার এই বিবাহে ঘোর আপত্তি ছিলো, তাই চক্রবর্তীর কন্যা ওই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য একদিন শরৎচন্দ্রের পায়ে পড়ে অনুরোধ জানায়। তখন শরৎচন্দ্র বাধ্য হয়ে নিজেই তাকে বিয়ে করেছিলেন।

শরৎচন্দ্র তার স্ত্রী শান্তি দেবীকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। তাঁদের একটি পুত্রও হয়। পুত্রের বয়স যখন এক বৎসর, সেই সময় রেঙ্গুনেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী এবং শিশুপুত্র উভয়েরই মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে শরৎচন্দ্র তখন গভীর শোকাহত হয়েছিলেন।

শান্তি দেবীর মৃত্যুর অনেকদিন পরে শরৎচন্দ্র ওই রেঙ্গুনেই দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। বিবাহের সময় পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের এই দ্বিতীয়া স্ত্রীর নাম ছিল মোক্ষদা। বিবাহের পর শরৎচন্দ্র তাঁর মোক্ষদা নাম বদলে হিরণ্ময়ী নাম দিয়েছিলেন এবং তখন থেকে তাঁর এই নামই প্রচলিত হয়। বিয়ের সময় হিরণ্ময়ী দেবীর বয়স ছিল ১৪।

হিরণ্ময়ী দেবীর বাবার নাম কৃষ্ণদাস অধিকারী। তার মূল বাড়ি মেদেনীপুর জেলায় শালবনীর কাছে শ্যামচাঁদপুর গ্রামে। কৃষ্ণবাবু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আট বছর বয়সী কনিষ্ঠা কন্যা মোক্ষদাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে এক মিস্ত্রী বন্ধুর কাছে রেঙ্গুনে এসেছিলেন। তাঁর পুত্র ছিল না। তিনি ক্ষীরোদা, সুখদা ও অপর একটি কন্যার বিয়ে আগেই দিয়েছিলেন।

হিরণ্ময়ী দেবী যখন রেঙ্গুনের মিস্ত্রীপল্লীতে তাঁর বাবার কাছে থাকতেন, সেই সময় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বাবার বিশেষ পরিচয় হয়। এই বিশেষ পরিচয়ের জোরেই হিরণ্ময়ী দেবীর বাবা একদিন সকালে কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করে করে বলেন- আমার মেয়েটির এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। একে সঙ্গে নিয়ে একা বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় থাকি! আপনি যদি অনুগ্রহপূর্বক আমার এই কন্যাটিকে গ্রহণ করে আমায় দায়মুক্ত করেন তো বড় উপকার হয়। আর একান্তই যদি না নিতে চান তো, আমায় কিছু টাকা দিন। আমি মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে যাই। দেশে গিয়ে মেয়ের বিয়ে দিই।

কৃষ্ণবাবু শেষে শরৎচন্দ্রের কাছে টাকার কথা বললেও, তিনি বিশেষ করে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করেন, যেন তিনিই তাঁর কন্যাটিকে গ্রহণ করেন। শরৎচন্দ্র প্রথমে অরাজী হলেও কৃষ্ণবাবুর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন।

হিরণ্ময়ী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। বিয়ের সময় পর্যন্ত হিরণ্ময়ী দেবী লেখাপড়া জানতেন না। পরে শরৎচন্দ্র তাকে লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন। হিরণ্ময়ী দেবী ছেলেবেলা থেকেই শান্তস্বভাবা, সেবাপরায়ন ও ধর্মশীলা ছিলেন। শরৎচন্দ্র তাকে নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখে শান্তিতেই কাটিয়ে গেছেন।

আজ এই জনপ্রিয়তম বাঙালি কথাসাহিত্যিকের জন্মদিন। ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলী জেলার সরস্বতী নদীর তীরে দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে এই মহানব্যক্তিকে অসংখ্য শুভেচ্ছা।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়