ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষাই ছিল তার ব্রত

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষাই ছিল তার ব্রত

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণের একটি দুর্লভ ছবি, ইনসেটে শামছুল হুদা পাঁচবাগী

হাসান মাহামুদ : আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রামগুলোর একটি। ১৯৭১ সালে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে কেউ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন অস্ত্র হাতে, কেউ অংশ নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। বিপদে পড়া বাঙালিদের সাহায্য করেও অনেকে মুক্তির সংগ্রামে দেশের হয়ে কাজ করেছেন।

মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী ১৯৭১ সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের একটি প্রসিদ্ধ চরিত্র। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ছিল ভিন্ন মাত্রার। যুদ্ধের সময় সবাই যখন নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন দেশের নিরীহ মেয়েদের অকাতরে সাহায্য করে গেছেন তিনি।

মাওলানা শামছুল হুদা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সব মেয়েদের রক্ষা করার চেষ্টা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরীহ মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন- এমন লোকের সংখ্যা তখন খুব কমই ছিল। এই মহৎ কাজটি করেছেন শামছুল হুদা পাঁচবাগী। তিনি নিজে বিভিন্ন গ্রামে, মহল্লায় বাসিন্দাদের খোঁজ নিতেন এবং নিরীহ ও বিপদে পড়া মেয়েদের নিজের জিম্মায় নিয়ে আসতেন। তাদের আশ্রয় দিতেন তার বাড়িতে। কাউকে কাউকে তিনি মসজিদে ও মাদরাসায় আশ্রয় দিতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেয়েদের সম্ভ্রম ও জীবন রক্ষা করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন এই মহান ব্যক্তি।

তিনি সকল আশ্রিতের খাবারের ব্যবস্থা করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহী যুবকদেরকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নির্দেশ দিতেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই আলেমের ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮৮ সালে আজকের দিনে (২৪ সেপ্টেম্বর) শতাধিক বছর বয়সে তিনি ময়মনসিংহ শহরের ব্রাহ্মপল্লীতে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।

মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী আরো একটি কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বাংলার প্রথম স্বাধীনতাকামী রাজবন্দি বলা হয় তাকে। এমনকি বিষয়টি জাতীয় সংসদেও স্বীকৃত। জীবদ্দশায় তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, একাধারে তিন দশক ধরে তিনি এমএলএ এবং এমএনএ নির্বাচিত হন।

শেরেবাংলা ও মাওলানা ভাসানীর শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম ইশতেহার সাহিত্য রচনায় হাত দেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় ১০ হাজারেরও অধিক ইশতেহার প্রকাশ করেন। তার পকিস্তান বিরোধী ইশতেহারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘মিছে কেন পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ইংরেজকে তাড়াই পাঞ্জাবি আনতে যাই, বাংলা নহে স্বাধীন, বাংলা চির পরাধীন’, ‘পাকিস্তান হয় ফাঁকিস্তান, পাকিস্তান হবে জালেমের স্থান।’

শামছুল হুদা পাঁচবাগী বাংলা ও উর্দু ভাষায়- দীন দুনিয়া, হুজ্জাতুল ইসলাম ও তর্জুমানে দীন নামে তিনটি পত্রিকায় সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। তিনি আমৃত্যু ঐতিহাসিক শাহজাদী বেগম ওয়াকফ স্টেটের মোতাওয়াল্লি ছিলেন।

মাওলানা মো. শামছুল হুদা পাচঁবাগী ১৮৯৭ সালে (বাংলা ১৩০৩ সালের ফাল্গুন মাস) ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণ মহকুমার অধীন গফরগাঁও থানার অর্ন্তগত মাইজবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী ক্বারী মো. রিয়াজ উদ্দিন পীরে কামেল ও মোকাম্মেল হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন। তার মা উম্মে কুলসুম ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন।

শিশুকালে তিনি মায়ের কাছে শিক্ষা শুরু করেন। কোন স্কুল বা মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। তিনি এতই মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন যে, কোন বিষয়ই একবারের অধিক পড়ার প্রয়োজন হত না। মাদরাসায় ভর্তির পর হতেই শামছুল হুদার প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। তিনি খুব আগ্রহের সঙ্গে প্রতিটি শ্রেণিতে সিলেবাস বর্হিভুত নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি জামাত ই উলা চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৯৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতের রামপুর স্টেট মাদরাসায় ভর্তি হন। মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে তিনি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য লাহোরে ওরিয়েন্টাল কলেজে ভর্তি হন।

মাওলানা শামছুল হুদা দেশে ফিরে আসার পর সামাজিক অবস্থা ও জনগণের করুন দশা দেখে বিদ্রোহ করতেন। বিশেষ করে জমিদারদের অত্যাচারে দেশের জনগণ সর্বশান্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করত ও মুসলমান প্রজারা গরু কোরবানি করতে পারত না। যদি কোন মুসলমান গরু কোরবানি করত তা হলে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী জরিমানা আদায় করত। মাওলানা শামছুল হুদা এর প্রতিবাদে আন্দোলনের ডাক দেন এবং হোসেনপুর এলাকায় ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করে প্রকাশ্যে গরু কোরবানি করেন।

এরপর থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের মেহনতি মানুষ ও কৃষকদের মুক্তির জন্য সারা জীবন আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। আন্দোলন করার কারণে ব্রিটিশ সরকার, জমিদার সংগঠন এবং পাকিস্তান সরকার ১০১৭টি মামলা দায়ের করেন মাওলানা পাচঁবাগীর নামে। এসব মামলার কারণে তাকে ময়মনসিংহ শহরে আট বছর নজরবন্দি হিসেবে আটকে রাখা হয়।

তিনি সরকার বিরোধী আন্দোলনের জন্য সর্বপ্রথম পাচঁবাগ গ্রামে একটি প্রেস স্থাপন করেন। সেই প্রেস থেকে ইস্তেহারের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করতেন। তিনি একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কবি, জনপ্রতিনিধি, আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। যে সময় মাদরাসায় শুধু আরবি ছাড়া অন্য কোন বিষয় সিলেবাসে অর্ন্তভুক্ত ছিল না, তখনকার সময়ে তিনি তার প্রতিষ্ঠানে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গনিতসহ সিলেবাস বর্হিভুত পড়াশোনা করাতেন। তিনি নারী শিক্ষার অগ্রপথিক ছিলেন। তিনি নিজ বাড়িতে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়