ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঘুইঙ্গার হাটের মিষ্টি মানেই শংকর দত্ত

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৭, ১৭ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঘুইঙ্গার হাটের মিষ্টি মানেই শংকর দত্ত

শংকর দত্ত

শাহেদ হোসেন : মিষ্টির প্রতি ভোলার মানুষের আগ্রহটা বোধ হয় অন্য অঞ্চলের তুলনায় একটু বেশিই। লঞ্চ থেকে ভোলা খেয়াঘাটে নামার পর জেলা সদর পর্যন্ত যেতে যেতে অন্তত অর্ধশত মিষ্টির দোকান আপনি খুঁজে পাবেন। অতিথি আপ্যায়ন কিংবা জামাই আপ্যায়ন-ভোলাবাসীর প্রথম পছন্দ হচ্ছে মিষ্টি। এই দ্বীপজেলার কোন অঞ্চলের মিষ্টি বিখ্যাত-জানতে চাইলে স্থানীয়রা এককথাতেই জানান ঘুইঙ্গার হাটের কথা।

ভোলা সদর থেকে পাঁচ মাইল দক্ষিণে এই ঘুইঙ্গার হাটের বিখ্যাত ও আদি মিষ্টির দোকান হচ্ছে ‘শংকর দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডার’। মূলত: ঘুইঙ্গার হাটের মিষ্টি বলতে শংকর দত্তের দোকানের মিষ্টিকেই বোঝানো হয়।

মধ্যবয়সী শংকর দত্ত জানালেন, বরিশালের মুলাদি থেকে স্বাধীনতার আগে তার দাদা স্বপরিবারে ভোলা চলে আসেন। বাবা সন্তোষ দত্ত  আর ভাই অসীত দত্ত গ্রামের বিভিন্ন হাটে মিষ্টি ফেরি করতেন। তখন ছিল চিনির দানাদার মিষ্টি। চার আনা করে  চারটার দাম হতো এক টাকা।  পরবর্তীতে সন্তোষ দত্ত ঘুইঙ্গার হাট বাজারের উত্তর পাশে ছোট্ট একটি মিষ্টির দোকান করেন। বাজারে তখন দোকান-পাটের সংখ্যা ছিল সাকুল্যে দুই থেকে তিনটি।

১৯৮৬ সালে  ভোলা-১ (ভোলা সদর) আসনের প্রাক্তন সংসদ সদস্য নাজিউর রহমান মঞ্জুর সঙ্গে দেখা করতে  তার দিঘলদীর বাসভবনে সরকারি কর্মকর্তারা আসতেন। তখন তারা বাজারে এলে সন্তোষ দত্তের দোকানে বসে মিষ্টি খেতেন। এখান থেকেই ধীরে ধীরে রসে ভেজা মিষ্টির নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০১ সালে বাজারের দক্ষিণ পাশে দোকান সরিয়ে নিয়ে আসা হয়।

শংকর দত্ত জানান, তার বাবা নিজের হাতে মিষ্টি বানাতেন। তাকে সহযোগিতা করতেন স্ত্রী শেফালি রানী দত্ত। কারিগরের হাত দিয়ে কখনোই মিষ্টি বানানো হয়নি। বোন শেফালির কাছ থেকে পরবর্তীতে মিষ্টি বানানো শেখেন অঞ্জু রানী দে।  বাবার মৃত্যুর পর এই খালার কাছ থেকেই মিষ্টি বানানো শেখেন শংকর দত্ত।

ভেজা মিষ্টি


বাবার কাছ থেকে কেন শেখেননি জানতে চাইলে কাঁচা-পাকা চুলের শংকর দত্ত মুচকি হেসে বলেন, ‘তহন তো দুষ্টু আছিলাম। শেখার সময় কই?’

মিষ্টি বানানোর প্রক্রিয়া জানতে চাইলে শংকর দত্ত জানান, তার দোকানের মিষ্টি তৈরি হয় দেশি গরুর দুধের ছানা দিয়ে। প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে তিন মণ দুধের ছানা লাগে। ভালো দুধ হলে মণে সাত কেজি ছানা হয়।  আর এই ছানায় ছয় থেকে সাতশ পিস মিষ্টি হয়।

বেচাকেনা কেমন হয়? দোকানের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে শংকর দত্ত জানালেন, তার দোকানে কোনো ফ্রিজ নেই। তিনি বাসী ছানা দিয়ে মিষ্টি তৈরি করেন না। দুপুরে গোয়ালা এসে দুধ দিয়ে যাওয়ার পর ছানা কাটা হয়। সন্ধ্যার পর মিষ্টি বানানোর কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় রাত ১১টায়। পরের দিন সন্ধ্যাতেই মিষ্টি শেষ।

চাহিদা থাকলেও কেবল ঐতিহ্যগত মান ধরে রাখতে বেশি মিষ্টি তৈরি করেন না বলে জানান শংকর দত্ত। তিনি বলেন, ‘হুট কইরা এক হাজার-দুই হাজার পিস মিষ্টির অর্ডার দিলে আমি নেই না।  অনেকে পাউডার দুধ দিয়া মিষ্টি বানায়, আমি ওইডা করি না। আবার ধরেন, অনেকে আগের দিন ছানা কাইটা ফ্রিজে রাইখা দেয়। আমি বাসী ছানা দিয়া মিষ্টি বানাই না। ঈদে দুধ ঠিকমতো পাওয়া যায় না। হেই টাইমে মিষ্টিরও ম্যালা চাহিদা থাহে। হের পরেও আমরা মিষ্টি বানাই না। হেই সময় দোকান বন্ধ রাহি।’

শংকর দত্তের দোকানে দু’ধরণের মিষ্টি হয়। একটি হচ্ছে চিনির রসে ভেজা, আরেকটি শুকনো। দুটোরই চাহিদা ব্যাপক। তবে শুকনো মিষ্টিটি অনেকে বিদেশে স্বজনদের কাছে পাঠান। এখানে কেজিতে মিষ্টি বিক্রি হয় না। বিক্রি হয় পিস হিসেবে। প্রতি পিস ১২ টাকা করে। তবে বাজারের অন্য দোকানগুলোতে একই সাইজের মিষ্টি বিক্রি হয় ৯/১০ টাকায়। দামের ফারাক হলেও পার্থক্যের ফারাকটা মিষ্টিপ্রেমীরা ঠিকই বোঝেন।

শুকনো মিষ্টি


একসময় এই দোকানে সিঙ্গারা বানানো হতো । প্রতি পিস এক টাকা করে বিক্রি হতো। এখন বিকেলে লুচি বানানো হয়, তিন টাকা করে প্রতিটি। সিঙ্গারা বানানো বন্ধ কেন জানতে চাইলে শংকর দত্ত বললেন, ‘কারিগর কাম লয়া নয়-ছয় করে। হেল্লেগা বন্ধ কইরা দিছি।’

দোকানে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন ক্রেতাও চলে এসেছেন। এদেরই একজন ভোলা সদরের কাপড়ের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ফয়সাল। তিনি জানালেন, একটু কষ্ট হলেও এখানে তিনি নিয়মিত আসেন মিষ্টি খাওয়ার জন্য। সদরের ঘোষপট্টিতে ১৫/২০টি মিষ্টির দোকান থাকলেও কারো মিষ্টিই এখানকার মতো হয় না।

এমভি ভোলা লঞ্চের মাস্টার আব্দুল খালেক জানালেন, শংকর দত্তের দোকানের সিঙ্গারা একসময় খুব চলতো। আর ঘুইঙ্গার হাটের মিষ্টি মানেতো শংকর দত্তের মিষ্টির দোকানই। ভোলার কারো মিষ্টিই এই দোকানের মতো না।

বাবা মারা গেলেও এখনো যৌথ পরিবার ধরে রেখেছেন শংকর দত্ত। তার দুই ছেলের মধ্যে একজন ভোলা সদরে কম্পিউটারের দোকান দিয়েছে। আরেক ছেলে বরিশালের একটি বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজে পড়াশোনা করছে।

এই পরিবারের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে দোকানের মুসলমান দুই কারিগর। ওদের বয়স ৪০ ছুঁইছুঁই। অনেকে চলে গেলেও ওরাই রয়ে গেছে আপনজনের মতো।


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ অক্টোবর ২০১৭/শাহেদ/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়