ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাহেলা এখন রিকশা চালান ঢাকা শহরে

আমিনুর রহমান হৃদয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ২৩ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাহেলা এখন রিকশা চালান ঢাকা শহরে

রাহেলা বেগম

আমিনুর রহমান হৃদয়: ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে নিজের খরচ ও ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন রাহেলা বেগম। তার বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কলমিচর মাতবরকান্দি গ্রামে। বর্তমানে থাকেন ঢাকার কামরাঙ্গীচরের কয়লাঘাট এলাকায়।

সম্প্রতি রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা হয় রাহেলা বেগমের। তিনি জানান, পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার কয়েক মাস পরই তার বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পরই ছেলে সন্তানের মা হন তিনি। এরপর দেড় বছরের মাথায় আবারো কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়ার পর যৌতুকের জন্য স্বামী তাকে নির্যাতন শুরু করে।

রাহেলা জানান, যৌতুকের টাকার জন্য স্বামী তাকে প্রতিদিনই মারধর করতো। ‘তোর বাপের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আন, নাইলে তোরে ভাত খাওয়ামু না। ভাগাই দিমু। আরেকটা মেয়েরে তো আমি ভালোবাসতাম। ওই তো আমারে কয় দুই লাখ টাকা দিব। ওরে বিয়া কইরা ফালামু।’ এভাবেই তার স্বামী খোকন খাঁ তাকে মারধর করার সময় হুমকি দিতো।

২৫ বছর বয়সি এই নারী রিকশাচালক বলেন, একটা সময় আমার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে আমি স্বামীকে বলি, ‘আপনি যদি আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারেন, তাহলে থাকেন। আমার কিছুই করার নাই।’

বিয়ের ৪ বছর পর স্বামী তাকে ছেড়ে অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করে সংসার শুরু করে। রাহেলা তখন বাবার বাড়ি ফিরে আসেন। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেন। তখন তার কন্যা সন্তানের বয়স মাত্র ১ বছর।
 


এরপরও খোকন খাঁ তাকে হয়রানী করতে ছেলে ও মেয়েকে নিজের কাছে নিতে মামলা করেন। তবে বাচ্চাদের বয়স কম হওয়ায় শরীয়তপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওই মামলায় রায় দেন, মায়ের কাছেই বাচ্চারা থাকবে। তবে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত যদি বাচ্চাদের খরচ বহন করেন খোকন খাঁ, তবে সে পিতা হিসেবে সন্তানের দাবি করতে পারবেন। এই মামলার রায়ের পর সন্তানের আর কোনো খোঁজ রাখেননি খোকন।

রাহেলা বলেন, ‘আমার বাবা এমনিতেই গরিব। আমরা ৪ বোন ৩ ভাই। আমার ও আমার সন্তানদের খরচ চালাতে বাবার কষ্ট হতো। আমি তখন মায়ের কাছে সন্তানদের রেখে ২০১১ সালে ঢাকায় কাজের সন্ধানে চলে আসি।’

ঢাকায় আসার পরই মূলত শুরু হয় রাহেলার সংগ্রমী জীবন। তিনি বলেন, ‘সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক ৭০০ টাকা মুজুরিতে কারখানায় কাজ করি। কিন্তু তাতে খরচ চলতো না। কিছুদিন কারখানায় কাজ করার পর গার্মেন্টসে কাজ করি। কিন্তু সেই গার্মেন্টস কয়েক মাস পর বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাসা বাড়িতে কাজ করা শুরু করি। সেখানে কাজ করার সময় ম্যাডামরা মারধর করতো। আমার স্বামী নাই দেখে নানা কথা বলে অপমান করতো। তখন বাসা বাড়িতে কাজ করা ছেড়ে দিই। সিদ্ধান্ত নিই নিজেই কিছু করার।’

৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গত ৩ মাস আগে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছেন রাহেলা বেগম। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা সাইকেল চালানো শিখেছিলাম। সেটাই এখন জীবনে কাজে লাগলো।’

রিকশা চালিয়ে মোটামুটি ভালো টাকা আয় হচ্ছে এ কথা জানিয়ে রাহেলা বলেন, ‘ছেলেমেয়ের খরচ ও নিজের খরচ চালাতে এখন সমস্যা হচ্ছে না। প্রতি মাসে প্রায় ২২ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে অবশ্য ঋণের কিস্তি দিতে হয়। ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে ভালোই আছি। রিকশা চালাতে আমার কোনো সমস্যা হয় না।’

শরীয়তপুরের স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণীতে ছেলে ও ১ম শ্রেণীতে মেয়ে পড়াশোনা করছেন বলে জানান তিনি। স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে রাহেলা বেগম বলেন, ‘নিজেকে নিয়ে তো স্বপ্ন দেখার বয়স শেষ। এখন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছি। তাদের পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। যেহেতু ছেলেমেয়ের জন্ম দিছি, ওদের কর্ম করে যেন যেতে পারি। আর কিছু চাই না। যে কয়টা দিন আছি, যেন ভালোভাবে কাজ করে ডাল-ভাত খেয়ে কাটাতে পারি।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ অক্টোবর ২০১৭/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়