ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নাইট: বীরযোদ্ধা থেকে উপাধি বৃত্তান্ত

কে এম আব্দুল মোমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৩, ৩০ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নাইট: বীরযোদ্ধা থেকে উপাধি বৃত্তান্ত

কে এম আব্দুল মোমিন : সাধারণত কোনো রাজা বা দেশের প্রতি সামরিক বা অন্য কোনো সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো রাজা বা রাজনৈতিক নেতাসংশ্লিষ্ট সেবাদানকারীকে সম্মানসূচক ‘নাইট’ পদবি প্রদান করে থাকেন। প্রাচীনকালে ইউরোপে অশ্বারোহী যোদ্ধাকে নাইট উপাধি দেওয়া হতো। মধ্যযুগে নাইটদের আভিজাত্যের দিক থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের মহৎ ব্যক্তিরূপে গণ্য করা হতো। পরবর্তীকালে নাইটদের সম্পূর্ণরূপে আদর্শ গুণসম্পন্ন রাজকীয় খ্রিস্টান যোদ্ধারূপে গণ্য করা হয়। সামন্ত প্রভুদের পক্ষে তাঁরা বিশ্বস্ত ও দক্ষতার সাথে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতেন। ভূমিরাজস্ব হতে তাঁদের ব্যয় নির্বাহ করা হতো। সূচনাকাল থেকেই নাইট পদবি সম্মানসূচক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাধারণত ব্রিটিশ রাজা বেসামরিক ব্যক্তিদেরকেও দেশসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ নাইট উপাধি প্রদান করে থাকেন। মহিলাদের ক্ষেত্রে ‘ডেইম’ বলা হয়।

ব্রিটেন ও ফ্রান্সে মধ্যযুগের সাহিত্যে নাইটদের ব্যাপক বিচরণ লক্ষ করা যায়। ১১৩০ খ্রিস্টাব্দে লিখিত মনমাউথের জিওফ্রে লিখিত ‘হিস্টোরিয়া রিগাম ব্রিটানিয়া’তে কিং আর্থারের লোককাহিনী উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নাইটদের ইতিহাস তুলে ধরা হয়। ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত স্যার থোমাস ম্যালোরির ‘লি র্মট ড’আর্থার’ (আর্থারের মৃত্যু) এর মাধ্যমে নাইটদের আদর্শ, বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। তাঁরা ছিলেন উঁচুমানের অভিজাত যোদ্ধা। বিশ্বাস, আনুগত্য, বীরত্ব ও মর্যাদা রক্ষার্থে তাঁরা নিজেদের জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করতেন। এছাড়া, জিওফ্রই ডি চার্নির ‘বুক অব শিভালরি’ গ্রন্থে নাইটদের জীবনের প্রতিটি স্তরে খ্রিস্টধর্মীয় বিশ্বাসের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের সময় সাহিত্যে শিভালরিক রোমান্স বা বীরদের দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনী অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ ধারণার উপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের বাস্তবতার সৃষ্টি হয়। ফলে মিগাল ডি সারভান্টিসের ‘ডন কুইজোট’-এর মতো জনপ্রিয় সাহিত্য রচিত হয়। এ উপন্যাসে নাইটদের আদর্শ গুণাবলী ও সারভান্টিসের বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁদের বৈসাদৃশ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। মধ্যযুগের শেষ দিকে যুদ্ধের কলাকৌশল ও অস্ত্রশস্ত্রের পরিবর্তন ঘটে। ফলে, নাইটদের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র-শস্ত্রেরও বিলুপ্তি ঘটে। কালের সাক্ষী হিসেবে কেবল তাঁদের গৌরবময় পদবি টিকে থাকে।

নাইট শব্দটি প্রাচীন ইংরেজি ‘ক্নাইট’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ বালক বা ভৃত্য। সমগোত্রীয় জার্মান শব্দ ‘নেক্‌ট’, যার অর্থ ভৃত্য বা দাস। কিন্ত ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এ সমস্ত অর্থ হারিয়ে যায়। এ্যাংলো-স্যাক্সন যুগেও ক্নাইটদের সাথে অশ্বারোহণের কোনো সম্পর্ক ছিল না। শব্দটি ভৃত্যই বুঝাতো। তবে র‌্যাডক্নাইট বলতে এক ধরনের অশ্বারোহী ভৃত্য ছিল, যারা বার্তাবাহক অথবা সমুদ্রতীরে পাহারাদার হিসেবে কাজ করত।

১১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নাইট শব্দটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হারিয়ে রাজা বা অন্য কোনো প্রভুর সামরিক সঙ্গী বা যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এ ধরনের যোদ্ধা অবশ্যই অশ্বারোহী ছিলেন। ফ্রান্সের সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে সংঘটিত শতবর্ষের সমরেও (১৩৩৭-১৪৫৩) তাদের অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ হতে পূর্ণ মর্যাদার সাথে নাইট বা নাইটহুড শব্দগুলো ব্যবহৃত হতে থাকে।

নাইটদের প্রধান সঙ্গী একটি বিশ্বস্ত, শক্তিশালী এবং ক্ষিপ্র ঘোড়া

প্রাচীন মুসলিম জগতের ফুরুসাইয়া, গ্রিসের হিপাস ও রোমের ইকিস নামেখ্যাত অশ্বারোহী যোদ্ধাগণ বিশেষভাবে সমমর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী ছিলেন।

মধ্যযুগে নাইটদের মতো গুণাবলীসম্পন্ন আরবীয় সামরিক বীর যোদ্ধাদের ‘ফুরুসাইয়া’ বলা হতো। তাঁরা ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করেন। বিশেষত মামলুক আমলে সামরিক কলাকৌশলে তাঁরা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন ও ইসলামের ইতিহাসে অশ্বচালনায় স্বর্ণযুগের সৃষ্টি করেন। গ্রিসের ক্যাভালরি বা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের হিপাস বলা হতো। এথেন্সে সলোনের রাজনৈতিক সংস্কারের পর হিপাসরা সামাজিক চারটি স্তরের মধ্যে উচ্চতর দ্বিতীয় স্তরে মর্যাদা ভোগ করতেন।

প্রাচীন রোমে ‘ইক্সট্রিয়ান’ বলতে সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণির উচ্চতর মর্যাদার ব্যক্তিদের বুঝাতো। প্যাট্রিসিয়ান বা রাজন্যবর্গের পরেই তাঁদের স্থান ছিল। তাঁরা অশ্বারোহী ছিলেন। ‘ইক্সট্রিয়ান’ শব্দটির অনুবাদ করতে গিয়ে নাইট শব্দ ব্যবহৃত হয়। ল্যাটিন ভাষায় এর অর্থ বুঝানো হয় সৈনিক। সোলজার বলা হলে অবশ্য পদাতিক সৈন্য বুঝাতো। পরবর্তীকালে রোমান সাম্রাজ্যে ইকাসের পরিবর্তে ল্যাটিন শব্দ ক্যাবালাস ব্যবহৃত হতে থাকে। ক্যাবালাস থেকে ইংরেজিতে ক্যাভালিয়র ও ফরাসিতে শিভালিয়র শব্দের উৎপত্তি। এর সমগোত্রীয় ইংরেজী শব্দ হচ্ছে রাইডার। প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় শব্দটির মূল হচ্ছে রিড (reidh)। এ থেকে অনুমিত হয় প্রাচীন রোম থেকেই ইউরোপীয় নাইটদের আবির্ভাব ঘটে।

মধ্যযুগের প্রথমদিকে ল্যাটিন ভাষায় নাইটদের মতো সুসজ্জিত অশ্বারোহীদের বিবরণ পাওয়া যায়। অষ্টম শতাব্দীতে ফ্রাঙ্কসদের রাজা শার্লম্যানের রাজত্বকালে প্রথম নাইটদের দর্শন পাওয়া যায়। ফ্রাঙ্কসদের প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ক্যারোলিঙ্গীয় যুগে (৮০০-৮৮৮) তাদের প্রসার ঘটে। ফ্রাঙ্কসরা থাকত আক্রমণভাগে। সৈনিকদের জন্য ছিল অজস্র ঘোড়া। তারা রাজার সঙ্গে বিভিন্ন বিজয় অভিযানে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে যেত। জার্মানির রাইন ও ওয়েজার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্রের সংঘবদ্ধ জনগণ ফ্রাঙ্কস নামে পরিচিত ছিল। দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী যোদ্ধা বা ক্যাভালরি হিসেবেও তাদের খ্যাতি ছিল। তাদের সময়েই ঘোড়ায় চড়ে পা রাখার জন্য রেকাব বা পা-দানি আবিষ্কৃত হয়। ফলে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা আরও সহজ হয়। তারা জার্মানি ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

নাইটদের জন্য তৈরি বিভিন্ন ধরনের বর্ম

নাইটরা সুসজ্জিত হয়ে ঘোড়ায় চড়তেন। হাতে থাকত বল্লম। পরবর্তীতে বল্লমের পরিবর্তে আরও মজবুত বর্শার ব্যবহার প্রচলিত হয়। ক্যারোলিঙ্গীয় রীতি অনুসারে সাধারণত কোনো উৎসব উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যুবককে অস্ত্র-শস্ত্র প্রদান করে নাইট হিসেবে ঘোষণা করা হতো। তাদের সেবার বিনিময়ে পুরস্কার হিসেবে ভূমি মঞ্জুরি দেওয়া হতো। 

দশম ও একাদশ শতাব্দীতে নাইটরা শুধুমাত্র অশ্বারোহী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম ক্রুসেডে অংশগ্রহণকারী নাইটদের ‘নাইট হসপিটেলার্স’ ও ‘হলি সিফালকার’ হিসেবে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম উপাধি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ১১০০ খ্রিস্টাব্দে ‘অর্ডার অব লেজারাস’, ১১১৮ খ্রিস্টাব্দে ‘নাইটস টেম্পলার্স’ ও ১১৯০ খ্রিস্টাব্দে ‘টিউটনিক নাইটস’ উপাধি দেওয়া হয়। এভাবে দ্বাদশ শতাব্দী হতে তাঁদের গ্রেডেশন বা পদমর্যাদার প্রচলন শুরু হয়। নাইট পদবি ক্রমশ সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেব পরিগণিত হতে থাকে। অপরদিকে যোদ্ধাগণ ‘সশ্রস্ত্র যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত হতে থাকে।

নাইটদের প্রশিক্ষণ: দশম শতাব্দীর দিকে নাইটদের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে দেখা যায়। সামরিক ক্ষেত্রে যোদ্ধাদের যেমন নাইট উপাধি আবশ্যক হিসেবে বিবেচিত হয়, তেমনি বেসামরিক ক্ষেত্রে জায়গিরদার ও ভূস্বামীদের মতো অভিজাত ব্যক্তিবর্গকেও নাইট উপাধি দেওয়া হয়। তাদের আনুগত্য, নিরাপত্তা ও সেবা প্রদান নিশ্চিত করার লক্ষে এ সকল সামন্তপ্রভুদের ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হতো। তারা একদিকে রাজার প্রতি অনুগত থাকতেন, অপরদিকে নাইটদের বাসস্থান, খাদ্য, বর্ম, অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া ও অর্থ দিয়ে প্রতিপালন করতেন। যুদ্ধের সময় তারা অনুগত নাইটবাহিনী নিয়ে রাজার পক্ষে লড়াই করতেন। সুতরাং তাদেরও যথেষ্ট সামরিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা অপরিহার্য ছিল। যে নাইট নিজ পতাকা নিয়ে যুদ্ধ করতেন, তাকে ‘নাইট ব্যানারেট’ বলা হতো। আর যে নাইট অন্যের পতাকাতলে যুদ্ধ করতেন, তাকে ‘নাইট ব্যাচেলর’ বলা হতো।

অভিজাত বংশের সন্তানরাই নাইট হতে পারতেন। সাধারণত কোনো নাইট বা জমিদারের সন্তান নাইট হিসেবে দীক্ষাগ্রহণ করতেন। অসাধারণ সামরিক দক্ষতা প্রদর্শন করে সাধারণ ঘরের সন্তানরাও নাইট হতে পারতেন। অভিজাত বংশের সন্তানেরা সাত বছর বয়স পর্যন্ত অভিজাত পালক মাতার নিকট তাঁর প্রাসাদে থাকতেন। সন্তানের বয়স সাত বছর পূর্ণ হলে তাঁকে পেইজ বা শিক্ষানবিশ নাইট বলা হতো। তখন তাঁকে প্রাসাদের মালিকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হতো। পেইজরা দক্ষ শিকারিদের সঙ্গে বিভিন্ন জীবজন্তু শিকারের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন। তাঁরা বন্য বাজপাখি শিকার করে তাকে দিয়ে শিকার ধরার প্রশিক্ষণও দিতেন। ধর্মযাজকদের নিকটে তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তারপর তাঁরা নাইটদের সহকারী হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন। তাঁরা সেখানে নাইটদের অস্ত্রশস্ত্র বহন করতেন। সেগুলো পরিষ্কার রাখতেন। ঘোড়া দেখাশুনা করতেন। মালপত্র গুছিয়ে দিতেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অভিযানেও নাইটদের সঙ্গে এ সকল শিক্ষানবিশগণ যেতেন। তাদেরকে তরবারিচালনা, অশ্বারোহণ, নাইটসুলভ গুণাবলী, যুদ্ধবিদ্যা ও দ্বৈতযুদ্ধ শিখতে হতো।

মধ্যযুগের সশস্ত্র নাইট

যখন তাঁদের বয়স পনেরো বছর পূর্ণ হতো, তাঁদেরকে স্কয়ার বা অনুচর বলা হতো। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে যাজক বা পুরোহিত নতুন অনুচরের হাতে তরবারি তুলে দিয়ে আশীর্বাদ করতেন। তাঁর প্রভু বা মালিকের নির্দেশিত কাজকর্ম করতে বলতেন। এ সময়কালে তাঁকে নিজস্ব বর্ম পরিধানের অনুমতি দেওয়া হতো ও নিয়মিত যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হতো। সাধারণত একজন অনুচরকে সাতটি বিষয়ে ক্ষিপ্রতা অর্জন করতে হতো, যা ‘সপ্তক্ষিপ্রবিদ্যা’ নামে পরিচিত ছিল। এগুলো হচ্ছে ঘোড়ায় চড়া, সাঁতারকাটা ও ডুব দেওয়া, অস্ত্রচালনা, দীর্ঘলম্ফ ও নৃত্য, গাছে ওঠা, লড়াই প্রতিযোগিতা এবং মল্লযুদ্ধ। এ সমস্ত বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জিত হলে বর্ম পরিধানের অনুমতি দেওয়া হতো। এগুলো সবই নাইট হওয়ার পূর্বশর্ত ছিল। সাফল্যের সঙ্গে সকল বিষয় রপ্ত হলে এবং একুশ বছর পূর্ণ হলে, একজন স্কয়ার বা অনুচর নাইট হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেন। অবশ্য কোনো অনুচর যদি কোনো যুদ্ধে গৌরবময় সাফল্য ও দক্ষতা দেখাতে পারতেন, তাঁকে একুশ বছরের পূর্বেও নাইট হিসেবে ঘোষণা করা হতো।

নাইট উপাধি প্রদান অনুষ্ঠান: সাধারণত ক্রিসমাস বা ঈস্টার বা রাজকীয় বা কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বিবাহ অনুষ্ঠানের মতো বড় কোনো উৎসব উপলক্ষে উপযুক্ত সাহসী বীরকে নাইট উপাধি প্রদান করা হতো। অনুষ্ঠানের পূর্ববর্তী সন্ধ্যায় নাইট উপাধি প্রার্থীকে ধর্মীয় রীতি অনুসারে গোসল করানো হতো এবং রাতের বেলা তাঁকে উপাসনায় যোগ দিতে হতো। অনুষ্ঠানের দিনে যাজক তাঁকে তরবারি প্রদান করে শপথ করাতেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ‘মাইলস ক্রিশ্চিয়ানাস’ নামে রূপক গ্রন্থে দেখানো হয়েছে একজন নাইট কীভাবে পুণ্যবলে পাপের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করতে পারেন। তাঁর বর্মের একটি অংশ হচ্ছে খ্রিস্টীয় গুণাবলী। এভাবে বীরদের সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে মহিমান্বিত বীরত্বপূর্ণ মূল্যবোধের সম্পৃক্ততা ঘটেছে। বলা হয়েছে, হেলমেট বা শিরস্ত্রাণ হচ্ছে ভবিষ্যৎ আশীর্বাদের আশা, ঢাল হচ্ছে বিশ্বাস, বর্ম হচ্ছে পরহিত বা অন্যের উপকার, বর্শা হচ্ছে অধ্যবসায়, তরবারি হচ্ছে ঈশ্বরের বাণী, পতাকা হচ্ছে স্বর্গীয় ইচ্ছা, অশ্ব হচ্ছে সদিচ্ছা, অশ্বপৃষ্ঠের জিন বা গদি হচ্ছে খ্রিস্টধর্ম, লাগাম হচ্ছে বিচারবুদ্ধি, অশ্বকে পদাঘাত করার জন্য জুতোর নাল হচ্ছে শৃঙ্খলা, রেকাব বা পা-দানি হচ্ছে শুভকাজ, অশ্বের চার পায়ের ক্ষুর হচ্ছে আনন্দ, সম্মতি, শুভকাজ ও অনুশীলন।

নাইটদের নিকট প্রত্যাশা ছিল, তাঁরা সাহসের সাথে যুদ্ধ করবেন ও পেশাগত সামরিক দক্ষতা ও সৌজন্যবোধের পরিচয় দিবেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দি হলে, তাঁদেরকে ভালোভাবে সুন্দর পরিবেশে রাখা হতো। মুক্তিপণ নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হতো। এ আচরণবিধি নাইট ব্যতীত অন্য সৈনিকদের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। অন্য বন্দিদের প্রায়ই হত্যা করা হতো।

লড়াই প্রতিযোগিতা: যুদ্ধ ব্যতীত অন্য সময়ে নাইটদের দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য নানা ধরনের লড়াই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। সাধারণত কোনো রাজপ্রাসাদের আঙিনায় এ ধরনের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। লড়াই শুরু হওয়ার পূর্বে সদলবলে সুসজ্জিত নাইটদের পতাকাসহ প্যারেড প্রদর্শন করা হতো। মধ্যযুগে সবচেয়ে জনপ্রিয় লড়াই প্রতিযোগিতার নাম ছিল জাউস্ট। এ প্রতিযোগিতায় দুজন নাইট ঘোড়ায় চড়ে একে অপরের দিকে দ্রুতবেগে ছুটে গিয়ে একজনের বর্শা অপরজনের মাথায় বা শরীরে প্রচণ্ড আঘাত করে ভেঙে ফেলতেন অথবা প্রতিপক্ষকে অশ্বচ্যুত করতেন। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁরা তরবারি যুদ্ধেও লিপ্ত হতেন। পরাজিত নাইট বিজয়ী নাইটের নিকট আত্মসমর্পণ করতেন। দিনশেষে বিজয়ী নাইটকে পুরস্কৃত করা হতো। এ প্রতিযোগিতা কয়েকদিন যাবৎ চলত। পুরো প্রতিযোগিতা শেষে একজনকে সেরা বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হতো। তাঁকেও পুরস্কৃত করা হতো। শেষদিনে ভোজ উৎসবের আয়োজন করা হতো।

নাইটদের অন্যতম গুণ স্ত্রীলোক বা দুর্বলদের প্রতি সম্মান

এছাড়া, বিতর্কিত বিভিন্ন বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিবাদির পক্ষে লড়াই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। বিজয়ীপক্ষ নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হতো এবং পরাজিত পক্ষ শাস্তি পেত। জার্মানি, ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডে এ ধরনের লড়াই প্রতিযোগিতার ঐতিহ্য ছিল। কখনও দুজনের মধ্যে, কখনও দুদলের মধ্যে লড়াই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। বিচারকগণ এ সমস্ত লড়াই পর্যবেক্ষণ করতেন।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে নাইটপ্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে। বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে নিজস্ব পেশাদার সেনাবাহিনী গড়ে উঠতে থাকে। তাদের সাশ্রয়ে, সহজে ও স্বল্প সময়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও স্থানান্তর করা সম্ভব হয়। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষত বন্দুক আবিষ্কারের ফলে ধাতববর্মের ব্যবহার বিলুপ্ত হয়। অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে সৈনিকদের বন্দুক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। উপকরণসমূহের দামও সাশ্রয়ী হয়। বন্দুকের সাহায্যে বর্ম বা লক্ষ্য ভেদ করাও সহজসাধ্য হয়।

চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই সশস্ত্র পদাতিকবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ভারী অশ্বারোহী বাহিনীকেও আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে পরাজিত করতে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখেন। সুইজারল্যান্ডের সম্মীলিত বাহিনী ও লরেনের ডিউক রেনেলের বন্দুকধারী সৈনিকদের বিরুদ্ধে ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দের ০৫ জানুয়ারিতে সংঘটিত ন্যানসি যুদ্ধে বার্গান্ডির ডিউক চার্লস দ্য বোল্ডের বর্মপরিহিত নাইটদের অশ্বারোহীবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়।

তদুপরি, সামন্ত প্রথাও বিলুপ্ত হয়। সামন্ত প্রভুদের নিকট তখন বিপুল অর্থ ব্যয়ে নাইট পুষে রাখা অর্থহীন হয়ে পড়ে। অনেক ভূস্বামীরা ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য নাইটের পরিবর্তে অনুচর দিয়ে কোনমতে চাহিদা পূরণ করতে থাকেন।

১৫৬০ সালের পর থেকে নাইটহুড মূলত সামরিক সম্মান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র মর্যাদানির্ভর নাইট প্রথার প্রতি সকলের আগ্রহ হারিয়ে যায়। বিদ্যমান নাইটরা দ্রুত পেশাদার সেনাবাহিনীতে আত্মীকৃত হয়ে যায়। যদিও তারা তাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের খাতিরে সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিকদের চেয়ে উচ্চতর পদ লাভ করে, কিন্তু পূর্বের মতো সাধারণ সৈনিকের তুলনায় নাইট হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি পরিচিতি ও গৌরব হারিয়ে ফেলে।

নাইট যুগের অবসান ঘটলেও কেউ কেউ নাইটদের পদবি নিয়ে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করেন। তাঁদের গৌরবময় বীরত্বের ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থে তাঁরা সনাতন সমরাস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করেন। ‘নাইটস হসপিটেলার্স’ ও ‘টিউটোনিক নাইটস’-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।  



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়