গান যার উদ্বুদ্ধ হওয়ার মন্ত্র
শাহ মতিন টিপু : বিস্তীর্ণ দুপাড়ের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও /নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি গঙ্গা বইছো কেন / নৈতিকতার স্খলন দেখেও মানবতার পতন দেখেও/ নির্লজ্জ অলস ভাবে বইছো কেন - ভূপেন হাজারিকার গান অন্তর্ভেদী।তার গানে যেমন মুগ্ধ করে তেমনই ভিন্ন এক দায়িত্ববোধেও উদ্বুদ্ধ করে।
এই গানের প্রবাদপুরুষের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ।২০১১ সালের ৫ নভেম্বর সুরেলা কন্ঠের যাদুকর হয়ে যান অনন্ত পথের যাযাবর।
কিংবদন্তি এই শিল্পীর প্রতিটি গানই যেন উদ্বুদ্ধ হওয়ার মন্ত্র।ভূপেন হাজারিকার গান মানুষকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছে। যেমন- শরতবাবু খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে / তোমার গফুর মহেশ এখন কোথায় কেমন আছে/তুমি জান না/হারিয়ে গেছে কোথায় কখন তোমার আমিনা/শরতবাবু এ চিঠি পাবে কিনা জানি না।
আবার- গঙ্গা আমার মা /পদ্মা আমার মা/আমার, দুই চোখে দুই জলের ধারা/ মেঘনা, যমুনা /একই আকাশ একই বাতাস /একই হৃদয়ে একই তো শ্বাস/দোয়েল কোয়েল পাখির মুখে/একই মূর্ছনা ।
আবার- মোর গায়ের সীমানার পাহাড়ের ওপারে/নিশিথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি/ কান পেতে শুনি আমি বুঝিতে না পারি/ চোখ মেলে দেখি আমি দেখিতে না পারি /চোখ বুজে ভাবি আমি ধরিতে না পারি/হাজার পাহাড় আমি ডিঙুতে না পারি।
আবার- বলো কি তোমার ক্ষতি/জীবনের অথৈ নদী/ পার হয় তোমাকে ধরে/ দুর্বল মানুষ যদি /মানুষ যদি সে না হয় মানুষ/দানব কখনো হয় না মানুষ/যদি দানব কখনো হয় বা মানুষ/ লজ্জা কি তুমি পাবে না ?
অসাধারণ এই মহান শিল্পীর শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়। আসামিয়া, ফোক, বলিউড এবং আধুনিক গানকে তিনি জনপ্রিয় করেছেন। বাংলা ও হিন্দি দু’ভাষাতেই আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পায় তার গান। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢাকায় এসেও ভক্ত শ্রোতাদের মাতিয়ে যান তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের বাঁধন ছিল তার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিয্দ্ধু চলাকালে এই শিল্পীর সঙ্গীত স্বাধীনতাকামী জনগণের মাঝে যে আশার আলো জাগিয়েছিল তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
৩৩টি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেন তিনি । তার গাওয়া ও সঙ্গীত পরিচালনায় বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রুদালী’, ‘দামান’, ‘দারমিয়া’, ‘গজগামিনী’ প্রভৃতি। সর্বশেষ ২০০৬ সালে ‘চিঙ্গারী’ চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেন তিনি। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামে যৌথ প্রযোজনায় ছবিতে কণ্ঠ এবং ১৯৭৭ সালে ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবির সংগীত পরিচালনা করেন।
ভূপেন হাজারিকা ১৯৪২ সালে গোহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পাস করেন এবং পরে ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ পাস করেন। ১৯৫৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯৩ সালে তিনি আসাম সাহিত্য-সভার সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৯২ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার আজীবন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৫ সালে আঞ্চলিক চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার, ২০০১ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার, ২০০৯ সালে আসাম-রত্ন, ২০০৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি অ্যাডওয়ার্ড লাভ করেন। সেন্সর বোর্ড ও জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
এই মহান শিল্পী সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের মূল্যায়ন- ভূপেন শুধু গায়ক ছিলেন না, ছিলেন একজন মহান সমাজসংস্কারকও। ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের আসামে এই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পীর জন্ম ।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ নভেম্বর ২০১৭/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন