ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সীতাকুণ্ডের ঐতিহাসিক পরিচিতি

কে এম আব্দুল মোমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১২, ৫ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সীতাকুণ্ডের ঐতিহাসিক পরিচিতি

কে এম আব্দুল মোমিন : ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ব্রিটিশ খনিবিদ ড.জে. কগিন ব্রাউনের তথ্যানুসারে নব্য প্রস্তরযুগে (১০০০০-২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সিতাকুণ্ড-অঞ্চলে মানব বসতি শুরু হয়। তাদের ব্যবহৃত অনেক উপকরণ এ অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে।

খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫ম শতাব্দীতে মহর্ষী বাল্মিকী প্রণীত মহাকাব্য রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বর্ণনানুসারে সীতাকে বনবাসে প্রেরণ করা হয়। নিজের আশ্রমে বাল্মিকী তাকে আশ্রয়দান করেন। সীতাদেবীর স্নানের জন্য ঋষিবর ভার্গব একটি কুণ্ড তৈরি করেন। কুণ্ডটির নাম রাখেন ‘সীতাকুণ্ড’। কুণ্ড শব্দের অর্থ পুস্করনী বা পুকুর। এখানে সীতার বনবাসকালে স্বামী রাম তাঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ করতেন। সীতাকুণ্ড হতে সমগ্র অঞ্চল সীতাকুণ্ড নামে খ্যাত হয়।

চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চিমাঞ্চলের ৭০ কিমি দীর্ঘ ও ১০ কিমি প্রস্থবিশিষ্ট ভূভাগে বিস্তৃত সীতাকুণ্ডের উত্তর প্রান্তে বয়ে যাচ্ছে ফেনি নদী, দক্ষিণে প্রবাহিত হচ্ছে কর্ণফুলি নদী, পূর্বদিকে বইছে হালদা নদী ও পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে সন্দ্বীপ চ্যানেল। সন্দ্বীপ খাল ও হালদা নদীর বিভাজন রেখা চিনের প্রাচীরের মতো শৈল্পিক রেখা টেনে দিয়েছে সীতাকুণ্ড পর্বতমালা। হালদা নদীর দৈর্ঘ ৮৮ কিমি। কর্ণফুলি নদীর ৬টি শাখার মধ্যে এটা বৃহত্তম। সন্দ্বীপ চ্যানেল চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা পশ্চিম মোড়ানো ভূমির উত্তর প্রান্ত নির্দেশ করছে। আয়তন ২৮.৬৩ কিমি।

 


চন্দ্রনাথ পাহাড়, সীতাকুণ্ড

 

১১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চিনের হান বংশের সম্প্রসারিত সিল্করোডের সঙ্গে সীতাকুণ্ড যুক্ত ছিল। প্রধানত রেশম বা সিল্ক বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত এ রোড সিল্করোড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সিল্করোড ব্যবহার করে মানুষ তখন সিল্কসহ বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসার জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন দেশে সহজে ও নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারত।

বাংলাদেশের প্রাচীনতম এ জনপদ কখনও পূর্বদিকের মিয়ানমারের বৌদ্ধশাসক, কখনও বাংলার মুসলিম শাসকের করায়ত্ব হয়। পূর্বাঞ্চলীয় শাসকগণের আগমন ঘটে আরাকান রাজ্য হতে। আরাকান রাজ্যের জলদস্যুরাও দস্যুবৃত্তির উদ্দেশ্যে সীতাকুণ্ডে বার বার হানা দেয়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দীতে চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তী শতাব্দীতে অঞ্চলটি ভারতীয় বৌদ্ধ রাজা ধর্মপালের (৭৭০-৮১০ খৃস্টাব্দ) করতলগত হয়। ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গের সুলতান বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ (১৩৩৮-১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দ) এ অঞ্চল জয় করেন। তার রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। শের শাহ শূরির নিকট সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সুলতান বংশের পতন ও শূর বংশের প্রতিষ্ঠা ঘটে। তারপর অঞ্চলটি পুনরায় আরাকান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। আরাকানের বাৎসাউফ্যু (১৪৫৯-১৪৮২ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গের সুলতান বারবাক শাহকে পরাস্ত করেন। এ সময় কিয়াকচু (চন্দ্রজ্যোতি) সীতাকুণ্ডে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫৩৮-১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ ফিরিঙ্গি বা হার্মাদগণ চট্টগ্রামের মধ্যদিয়ে আরাকানি জলদস্যুদের সঙ্গে আঁতাত করে সীতাকুণ্ডে লুটপাট ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে কিছু সময়ের জন্য অঞ্চলটি আরাকানি প্যাগান দস্যুদের করায়ত্ব হয়। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি বুজর্গ উমিদ খান সীতাকুণ্ড জয় করেন।

খ্রিস্টীয় ১৮-১৯ শতাব্দীতে সীতাকুণ্ডে বৃটিশদের আগমন ঘটে। তারা এ সময় অঞ্চলটি স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করে। হিন্দুদের ৪৯টি মন্দির ও ৪টি আশ্রম, বৌদ্ধদের ৩টি মঠ এবং মুসলামানদের ২৮০টি মসজিদ ও ৮টি মাজার সীতাকুণ্ডের ধর্মপ্রাণ মানুষের সুদীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দের নিদর্শনরূপে প্রতীয়মান হয়। এগুলোর মধ্যে ৩২ কিমি দীর্ঘ সীতাকুণ্ড পর্বতমালার সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৩৫২ মিটার উঁচু চন্দ্রনাথ পর্বতশৃঙ্গে চন্দ্রনাথ মন্দির, প্রজ্ঞালোক মহাস্থবীর (১৮৭৯-১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাস্মরণ বিহার, সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে (১৫৩৩-১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত হাম্মাদির মসজিদ বিখ্যাত তীর্থস্থানরূপে সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীগণের নিকট সমাদৃত হয়। অপরদিকে এ প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন। এমন কী প্রাগৈতিহাসিক বৈদিক যুগের শেকড়ের সন্ধান এখানে পাওয়া যায়।

 


পাহাড়ের ওপর চন্দ্রনাথ ধাম
 

চন্দ্রনাথ মন্দির
পৌরাণিক সূত্রে জানা যায়, শক্তিদেবী ও শিবদেবতার সন্তুষ্টি সাধনের জন্য ব্রহ্মদেব এক যজ্ঞানুষ্ঠানের (বৈদিকমতে অগ্নিপূজা) আয়োজন করেন। শক্তিদেবী ব্রহ্মদেবের আমন্ত্রণে যজ্ঞানুষ্ঠানে উপস্থিত হন এবং এ বিশ্বসংসার সৃষ্টিতে তাঁকে সহায়তা করেন। ১০ জন মানসপুত্র সৃষ্টির পর ব্রহ্মদেব তার দক্ষিণ বৃদ্ধাঙ্গুল হতে দক্ষ, বক্ষ হতে ধর্ম, অন্তর হতে কামদেব এবং ভ্রুযুগল হতে অগ্নি সৃষ্টি করেন। এ ভাবে সৃষ্টিকর্ম সমাপ্তির পর ব্রহ্মদেব শক্তিদেবীকে শিবের নিকট ফিরিয়ে দেবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

একসময় ব্রহ্মদেবের পুত্র দক্ষ স্বীয় দক্ষতাগুণে মহারাজারূপে পরিগণিত হন এবং সতীকে কন্যারূপে পাওয়ার জন্য কয়েকটি যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী প্রসূতির গর্ভে ৮৯জন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী পঞ্চজনির গর্ভে ১১৬জন কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। সতী ছিলেন প্রসূতির গর্ভজাত কনিষ্ঠা কন্যা। দক্ষের অগোচরে ব্রহ্মদেবের ইচ্ছায় শক্তিদেবী এ ভাবে সতীরূপে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন। এ জন্মেও তিনি শিবের প্রতি অনুরক্ত ও পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।

মিথ্যে বলার দায়ে একবার মহাদেব শিব ব্রহ্মদেবকে অভিশাপ দেন এবং তাঁর সম্মুখে ব্রহ্মদেবের পঞ্চম মস্তকটি কর্তন করা হয়। বিষয়টি ব্রহ্মদেবের পুত্র দক্ষের মর্মপীড়া ও ক্ষোভের কারণ ঘটায় এবং তাঁর মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা জাগ্রত হয়। এ জন্য তিনি শিবকে অপছন্দ করতেন। তাঁর মতে, শিব নোংরা ভবঘুরে সন্ন্যাস জীবনযাপন করতেন। শিবের তন্ত্র ও ভূতপ্রীতি তাঁর পছন্দ ছিল না। পিতার এরূপ অপছন্দ সত্ত্বেও শিবকে সতী বিবাহ করেন।শিব ও সতীর বিবাহ মূলত শিবের প্রতি দক্ষের রোষাগ্নিতে ঘৃতাহুতি প্রদান করে।
মহাদেব শিবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মহারাজ দক্ষ বিপুল সমারোহে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। এ মহাযজ্ঞে সকল দেবদেবীকে নিমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু তিনি এ অনুষ্ঠানে ইচ্ছাকৃতভাবে শিব ও সতীকে নিমন্ত্রণ করেননি। এ জন্য শিব অপমানিত বোধ করেন এবং সতীকে যজ্ঞানুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করেন।

 


গড়ে উঠেছে জাহাজ ভাঙা শিল্প

 

সতী পিতামাতার কথা স্মরণ করে যজ্ঞানুষ্ঠানে যাবার অনুমতি দেবার জন্য স্বামীর নিকট অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে একা যাবার জন্য মহাদেব শিব অনুমতি দান করেন। উপায়ন্তর না দেখে তিনি একাই যজ্ঞানুষ্ঠানে উপস্থিত হন। এ অনুষ্ঠানে অনাহুত অতিথির মতো পিতার নিকট তাঁকে অবাঞ্ছিত মনে হয়। এমন কি সকল অতিথির উপস্থিতিতে মহারাজ দক্ষ তাকে তাঁর স্বামীর জন্য রীতিমত অপমান করেন। তিনি অনুপস্থিত শিবের উদ্দেশ্যে নানাবিধ অবমাননাকর মন্তব্য করেন। এ অবমাননা এবং অপমানের তীব্র দহন সতীর নিকট এত অসহনীয় ছিল যে, তিনি দ্রুত যজ্ঞানলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দান করেন।

সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি অবগত হয়ে শিব প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মত্ত হন। মাথার একগুচ্ছ চুল ছিঁড়ে মাটিতে পেটাতে থাকেন। আর এ ভাবে তিনি বীরভদ্র (রুদ্র) ও ভদ্রকলিকে (মহামায়া) স্মরণ করেন। তাঁরা শিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভূতের দলসহ দক্ষের যজ্ঞপুরীর উদ্দেশ্যে দক্ষিণে যাত্রা করেন। দ্রুত উপস্থিত হয়ে তারা যজ্ঞানুষ্ঠান লণ্ডভণ্ড করে দেন। সমগ্র যজ্ঞশালা মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। শুধু তাই নয়, তারা দক্ষের শিরোশ্ছেদ করেন। এ যজ্ঞানুষ্ঠানের পুরোহিত ভৃগুর শ্মশ্রুমন্ডল (দাড়ি) ছিন্ন করে ভূতেরা বিজয় উল্লাসে মত্ত হয়।

অবশেষে, শিবসহ দেবতাগণ দক্ষকে ক্ষমা করে। শিব তার শরীরে ভেড়ার মস্তক স্থাপন করে জীবনদান করেন। দেবতাগণের উপস্থিতিতে দক্ষকে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন করার অনুমতি দেয়া হয়।

অপরদিকে, শোকে-দুঃখে উন্মত্ত শিব যজ্ঞাগ্নির ভশ্মাবশেষ থেকে সতীর অর্ধদগ্ধ মৃতদেহ আপন স্কন্ধে তুলে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। শিবের প্রলয়ঙ্করী নৃত্যে মহাধ্বংসলীলা শুরু হয়। সমগ্র প্রাণী ও প্রকৃতি জগতে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। স্বর্গ-মর্ত্য মুহুর্মুহু আলোড়িত হতে থাকে। দেবতাগণ আশঙ্কা করেন, মহাদেবের এ প্রলয় নৃত্যে বিশ্বসংসার ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। দেবতাগণের অনুরোধে শিবের শোকসন্তপ্ত হৃদয়কে বিষ্ণুদেব প্রশমিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।

 


কমলদহ  ঝরনা, সীতাকুণ্ড

 

প্রলয়নৃত্য বন্ধ করলেও শিব তাঁর প্রেমিকা স্ত্রীর অর্ধদগ্ধ মৃতদেহ ত্যাগ করতে অসম্মত হন এবং তিনি সে মৃতদেহ বহন করে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতে থাকেন। তখন বিষ্ণুদেব রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সুদর্শন চক্র (১০৮টি ধারাল দাঁতযুক্ত তাঁত বোনার চাকার মতো আকৃতিবিশিষ্ট বিশেষভাবে তৈরি মারাত্মক অস্ত্র) প্রয়োগ করে শিবের অলক্ষ্যে সতীর এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছেদন করতে থাকেন এবং খণ্ডিত অংশগুলো ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, তিব্বত, ভুটান, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের ৫১টি স্থানে পড়ে। স্থানগুলো শক্তিপীঠ নামে খ্যাত হয়। মহাদেব শিবের নবরূপ ভৈরব, শক্তিদেবীর নবরূপ আদি পরাশক্তি ও ত্রিমূর্তিমাতার সম্মীলিত শক্তির প্রকাশ ঘটে।

সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পর্বতশৃঙ্গে সতীর দক্ষিণহস্ত পতিত হয়। এখানে শক্তিদেবীর ভবানীরূপ পরিগ্রহ হয়। স্মরণীয় তীর্থস্থান হিসেবে চন্দ্রনাথ মন্দির গড়ে ওঠে। সংস্কৃত রাজমালা গ্রন্থানুসারে প্রায় ১২০৪ খৃস্টাব্দে গৌড়ের বিখ্যাত আদিশূর বংশের রাজা বিশ্বম্ভর শূর জলপথে চন্দ্রনাথ মন্দির দর্শনের চেষ্টা করেন। নিগমকল্পতরুর কবি জয়দেব গোস্বামী সুদীর্ঘকাল চন্দ্রনাথ ধামে বসবাস করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের শিবভক্ত রাজা ধন্যমানিক্য চন্দ্রনাথ মন্দিরে প্রসাদ প্রেরণ করতেন। এমন কি তিনি এখান থেকে শিবমূর্তি নিজ রাজ্যে স্থানান্তরের চেষ্টা করেন। আজও দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভক্তকূল এ তীর্থস্থান পরিদর্শন করেন।

সীতাকুণ্ডের অগ্রযাত্রা
সীতাকুণ্ড পাহাড়ে বাংলাদেশের প্রথম ইকোপার্ক, বিকল্প জ্বালানিশক্তি হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বায়ুকল ও জিওথারমাল পাওয়ার স্টেশন  প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সীতাকুণ্ডের কুমিরায় বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পকারখানা রয়েছে। কৃষিপ্রধান অঞ্চল সীতাকুণ্ডে বিভিন্ন শিল্পকারখানার অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছে বহুকাল পূর্বেই। আজও তা অব্যাহত রয়েছে। দেশের অন্যতম প্রাচীন এ জনপদের পরিশ্রমী মানুষ এভাবে কৃষি, শিল্প ও বাণিজক্ষেত্র প্রসারের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কৃষি ও নগরসভ্যতা সম্প্রসারণের ফলে বনাঞ্চল হ্রাস পেতে থাকে। অতিরিক্ত মৎস্য শিকার শুরু হয়। স্থলভাগের পানিদূষণ ঘটতে থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হতে শুরু করে। ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস ও ঝড়ঝঞ্ঝার প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

সীতাকুণ্ড পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। বিভিন্ন তীর্থস্থান, বৈচিত্রময় নৈসর্গিক দৃশ্য ও ইকোপার্ক তাঁদের মুগ্ধ করে। ভারত, নেপাল, বালি, সাইপ্রাস, শ্রীলংকা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে অসংখ্য তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের সীতাকুণ্ডে আগমন ঘটে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির প্রান্তরে প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলশ্রুতিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্যদিয়ে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সীতাকুণ্ড বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করায়ত্ব হয়। তখন থেকে সীতাকুণ্ডে বাঙ্গালিদের সংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে, অপরদিকে, অবাঙ্গালিরা সীতাকুণ্ড ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গমন করতে থাকে। ১৮৫৭ খৃস্টাব্দে ভারতীয়দের স্বাধীনতা বিপ্লবের (সিপাহী বিপ্লব) পর কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে এদেশে বৃটিশ সরকারের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বদেশি ভারতীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে অর্ধদয়া যোগ আন্দোলনের সময় সীতাকুণ্ড কিছুকাল ভারতীয় জাতীয়তাবাদিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফেব্রুয়ারি ১৯০৮ খৃস্টাব্দে অঞ্চলটিতে কলকাতার কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের জন্য ইন্ডিয়ান পেট্রোলিয়াম প্রসপেক্টিং কোম্পানি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে এখানে ৭৬২ মিটার গভীরে খননকার্য পরিচালনা করে। পূর্ববঙ্গে এ ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম এটা ছিল প্রথম। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৪টি কূপ খনন করেও কোন সফলতা আসেনি।

 



১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের স্বাধীনতা বিপ্লবের (সিপাহী বিপ্লব) পর কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে এদেশে ব্রিটিশ সরকারের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুণ্ড ইস্ট বেঙ্গল সার্কেল অব রেইলওয়ে মেইল সার্ভিসে যুক্ত হয়। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুণ্ড থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটলে সীতাকুণ্ড তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুণ্ডে  মাত্র ১টি মুরগির খামার ছিল। ১৯৬০ খৃস্টাব্দে ২০০০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন গ্রিক জাহাজ এমডি আলপিন্স সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে ফৌজদারহাটের নিকট সৈকতে উঠে আসে। জাহাজটি ভাঙ্গার জন্য ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে চিটাগাং স্টিল হাউজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা ছিল এ দেশের প্রথম জাহাজভাঙ্গা শিল্প। এখানে গুল আহমদ জুট মিলস লিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় ২৬ অক্টোবর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সীতাকুণ্ড সেক্টর-১ এর নিয়ন্ত্রণভুক্ত ছিল। এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারণ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অসামান্য অবদান রাখে।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন পাকিস্তানি জাহাজ আল আব্বাস ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জাহাজটি ভাঙ্গার জন্য ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কর্ণফুলি মেটাল ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাহাজভাঙ্গা শিল্পে গতিসঞ্চারিত হয়। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ২০০৭ খৃস্টাব্দের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানকে অতিক্রম করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাহাজভাঙ্গা শিল্প হিসেবে খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করে। সীতাকুণ্ড সৈকতের ৮ কিমি বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ১৯টি ইয়ার্ডে ২০টি জাহাজের স্ক্র্যাপ হতে ১৫,০০,০০০ মেট্রিক টন লৌহজাত পণ্য উৎপাদিত হয়। রেজিস্টার্ড ৭০টি জাহাজভাঙ্গা শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৭০০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়। বর্তমানে পরিত্যাক্ত জাহাজের অভাব, পরিবেশ ও মানবাধিকার সংরক্ষণসহ বিভিন্ন কারণে এ শিল্পের কর্মকা- অনেক সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। সীতাকুণ্ড থানা থেকে সীতাকুণ্ড উপজেলা নামকরণ করা হয় ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমানে সীতাকুণ্ড শহরকে স্যাটালাইট টাউন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।

লেখক : গবেষক ও অনুবাদক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়