ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

হাজার চুরাশির মা ও নটী’র স্রষ্টার জন্মদিন

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাজার চুরাশির  মা ও নটী’র স্রষ্টার জন্মদিন

শাহ মতিন টিপু : দেশভাগের কারণে বাংলাদেশ থেকে যে সকল প্রতিভাবান ভারতে চলে যান, বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকারকর্মী মহাশ্বেতা দেবী তাদেরই একজন।

খ্যাতনামা  কথাশিল্পী মহাশ্বেতা দেবীর ৯২তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় বিখ্যাত এক সাহিত্যিক পরিবারের তার জন্ম।পিতা মণীষ ঘটক ছিলেন ‘কল্লোল’ সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি অধিকাংশ লেখা লিখতেন ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে। মহাশ্বেতা দেবীর কাকা ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক এবং মা ধরিত্রী দেবী ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও সমাজকর্মী। তিনি দুই বছর আগে ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই প্রয়াত হন।

মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয় শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তারপর তিনি ‘শান্তি নিকেতনে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

মহাশ্বেতা দেবী ১০০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ২০টিরও বেশি ছোটগল্প সংকলন রচনা করেছেন। তিনি মূলত বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। তবে সেই সব রচনার অনেকগুলো অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার প্রথম উপন্যাস ঝাঁসির রানির (লক্ষ্মীবাই) জীবনী অবলম্বনে । প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। এই উপন্যাসটি লেখার আগে তিনি ঝাঁসি অঞ্চলে গিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে তথ্য ও লোকগীতি সংগ্রহ করে এনেছিলেন।

১৯৬৪ সালের দিকে মহাশ্বেতা দেবী বিজয়গড় কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই সময়ে তার পরিচয় একজন সাংবাদিক ও একজন সৃজনশীল লেখক । লেখনীর একপর্যায়ে তিনি রচনা করেন ঔপনিবেশিক শক্তি ও সমকালীন সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুন্ডা জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ সংবলিত ‘অরণ্যের অধিকার’ (১৯৭৯)।

পশ্চিমবঙ্গের লোধা ও শবর উপজাতি, নারী ও দলিতদের লড়াই, অসহায়তার কথাই তার  লেখায় উঠে এসেছে৷ বহুবার ভারতের উপজাতি মানুষদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ভারতীয় এই কথাসাহিত্যিক৷তাদের অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছেন৷

মহাশ্বেতাদেবী সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (বাংলায়), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার সহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের চতুর্থ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ পেয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছিল।

মহাশ্বেতা দেবী আজীবন সংগ্রামী চিন্তা চর্চা করেছেন এবং দেশ ও মানুষ সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত হবে সেই লক্ষ্যে সাহিত্য রচনা করে চলেছেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী নন। তার সংগ্রাম চলেছে সাহিত্যচর্চা এবং জীবনচর্চার মাধ্যমে। পারিবারিকভাবেই তিনি এক সাহিত্যবেষ্টিত পরিমন্ডলে বড় হয়েছেন এবং সাহিত্যকেই জীবনে বেছে নিয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে দুটি কবিতা উপহার দিয়েছিলেন।

১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট নাট্যকার এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসার-জীবন ছিল দারিদ্র্য-পরিবেষ্টিত, এ-সময়ে মহাশ্বেতা দেবী রং-সাবান, রঙের গুঁড়া ফেরি করেন, ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে তার একমাত্র পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম হয়। তাদের সংসার-জীবন পনেরো বছরের বেশি টেকেনি।

পরবর্তীকালে তিনি লেখাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ঝাঁসীর রানী, অরণ্যের অধিকার ছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ঐতিহাসিক পটভূমিকায় খুদাবক্স ও মোতির প্রেমের কাহিনি নিয়ে রচিত ‘নটী’,  লোকায়ত  নৃত্য-সংগীতশিল্পীদের নিয়ে ‘মধুরে মধুর’, সার্কাসের শিল্পীদের বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে ‘প্রেমতারা’, ‘ যমুনা কী তীর’, ‘তিমির লগন’, ‘রূপরাখা’, ‘বায়োস্কোপের বাক্স’ ইত্যাদি। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে লেখা  ‘আঁধার মানিক’, ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু’, ‘ হাজার চুরাশির  মা’।

১৯৬২ সালে বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। সংসার ভেঙে গেলেও ছেলের জন্য খুব ভেঙে পড়েছিলেন। সে-সময় তিনি অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করতেও গিয়েছিলেন, চিকিৎসকদের চেষ্টায় বেঁচে যান। ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে তিনি ছেলে থেকে বিচ্ছিন্ন হবার যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ।

এরপর তিনি অসিত গুপ্তকে বিয়ে করেন ১৯৬৫ সালে,  কিন্তু সেই সংসারও ১৯৭৬ সালে ভেঙে যায়। নিঃস্বঙ্গ জীবন, বিচ্ছেদ-বিরহ-বেদনায় তিনি নিজেকে সঁপে দেন লেখা এবং শিক্ষার ব্রতে।

তিনি আদিবাসীদের নিয়ে প্রচুর ছোটগল্প লিখেছেন, গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য – শালগিরার ডাকে (১৯৮২), ইটের পরে ইট (১৯৮২), হরিরাম মাহাতো (১৯৮২), সিধু কানুর ডাকে (১৯৮৫) প্রভৃতি। এই সব গল্প-উপন্যাসে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে যেমন আদিবাসী প্রতিবাদী চরিত্র চিত্রিত করেছেন, তেমনি এদেশীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শোষণের প্রতি প্রতিবাদ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরে তুলে ধরেছেন।

মহাশ্বেতা দেবীর বিশেষত্ব এই যে, বাংলা উপন্যাসে দলিত শ্রেণির মানুষজনের সর্বাধিক উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, জার্মান, জাপানি, ফরাসি এবং ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এছাড়া অনেকগুলো বই ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যেমন – হিন্দি, অসমীয়া, তেলেগু, গুজরাটি, মারাঠি, মালয়ালম, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া এবং আদিবাসী হো ভাষা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জানুয়ারি ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়