ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

গ্রীনহাউস: ডিজাইন ও নির্মাণ-ধারণা

জায়েদ ফরিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গ্রীনহাউস: ডিজাইন ও নির্মাণ-ধারণা

মিশরের গিজা অঞ্চলের পিরামিড। ডান থেকে বামে কিয়পস্, খ্যাফরেন ও মিকেরাইনস পিরামিড

জায়েদ ফরিদ: অস্বাভাবিক বৈরি পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহুরে মানুষ একরকম টিকে থাকলেও পেরে উঠছে না গ্রাম-গঞ্জ-শহরতলীর সনাতন চাষীরা। শস্য ফলানো এখন আর আগের মত সহজ কাজ নয়। ভবিষ্যতে মানুষের সৃষ্ট পরিবেশ-দূষণ এমন মাত্রায় বেড়ে যেতে পারে যে অতিউন্নত প্রযুক্তি ছাড়া একফোঁটা বিশুদ্ধ জলও আমরা সংগ্রহ করতে পারব না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটাই আমাদের কৃতকর্মের পরম উপহার। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও কালবৈশাখী ছাড়া বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে খরা ও রোগবালাইয়ের অত্যাচার কম নয়। রাজস্থান ও দক্ষিণ ভারতের কৃষকের জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ। পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য যোগান দিতে নিশ্চিত উৎপাদনের লক্ষ্যে ক্রমশ বেড়ে চলেছে গ্রীনহাউসের সংখ্যা। উপমহাদেশেও এসব গ্রীনহাউস তৈরি হতে বাধ্য। তবে মূলত আবহাওয়ার কারণে এদের কাঠামোগুলো সব জায়গায় একরকম হতে পারে না।

গ্রীনহাউস নির্মাণে স্বাভাবিকভাবে আমাদের মাথায় আসে খাড়াভাবে তৈরি কোনো হাল্কা কাঠামো, যার ছাদ হয়ত পলিথিন বা প্লাস্টিক-ফেব্রিকের জাল দিয়ে তৈরি। সমস্যা হল, এ ধরনের কাঠামো ঝড়ো বাতাসের চাপ সহ্য করতে পারে না। ভিতরে বাতাস ঢুকলে এর ছাদ পাখির মত উড়তে উড়তে কোথায় গিয়ে পড়বে এবং কতটা অক্ষত অবস্থায় তা কেউ বলতে পারে না। এতদসত্ত্বেও আমাদের গ্রীনহাউস নির্মাণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে কারণ খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, রোগশোক সকল অবস্থাই বিদ্যমান এখানে। এমতাবস্থায় এমন ধরনের গ্রীনহাউস নির্মাণ করাই হবে সঙ্গত যা এসব বৈরিতার বেশ খানিকটা উর্ধ্বে।

পিরামিড আকৃতির গ্রীনহাউস


কাঠামো হিসাবে পিরামিড আকৃতির ঘর একটি বিকল্প হতে পারে। পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে বিল ওয়ারেন যখন গ্রীনহাউস তৈরি করছিলেন তখন সেটি ঝটকা বাতাসে উড়ে গিয়েছিল বহুদূর। যার পর তিনি নানা পরীক্ষা করে পিরামিড আকারের গ্রীনহাউস তৈরি করেছেন যা বহাল তবিয়তে টিকে আছে। ঢালু ছাদের কাঠামোতে বাতাস জোর করতে পারে না। তিনি কাঠামোর এই অনুপাতগুলো নিয়েছেন মিশরের পিরামিড থেকে যেগুলো পুরাতন সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে টিকে থাকা একমাত্র স্থাপনা।

প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে নির্মিত হয়েছে এসব পিরামিড যেগুলো ফেরাউন বাদশাদের সমাধিসৌধ। সবচেয়ে উঁচু ৩টি পিরামিডের মধ্যে খুফু বা কিয়প্সের (Cheops) পিরামিডই সবচেয়ে উঁচু, যদিও পাশাপাশি পিরামিডগুলো দেখলে মাঝখানের পিরামিডকেই উঁচু বলে মনে হয়। এটা খুফুর পুত্র খ্যাফরেন (Chephren)-এর পিরামিড। বুদ্ধিমান খ্যাফরেন স্বীয় পিরামিড-সমাধির জন্য নির্বাচন করেছিল উঁচু জায়গা। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, পিরামিডের পাশে নির্মিত মানুষ ও সিংহের শঙ্কর-মূর্তি স্ফিঙ্কস্-এর মুখটা আদতে খ্যাফরেনের। তৃতীয় পিরামিডটি অপেক্ষাকৃত ছোট, মিকেরাইনস-এর। ১২০০ শতাব্দিতে পিরামিড ভেঙে ফেলার জন্য শক্তিশালি টিম গঠন করা হয়েছিল মুসলিম শাসক আবদুল আজিজ বিন সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে। এই ভাঙার কাজ শুরু হয়েছিল তিনটির মধ্যে যেটি ছোট, সেই ‘মিকেরাইনস’ থেকে। কিন্তু বহু পরিশ্রমের পরও বাছাই করা বলিষ্ঠ কর্মীদের পক্ষে দিনে একটি বা দুটির বেশি পাথর সরানো সম্ভব হয়নি। পিরামিডের গা থেকে খুলে পড়া এই জগদ্দল পাথর মাটিতে এমনভাবে প্রোথিত হত যে সেখান থেকে একে পুনরুদ্ধার করা ছিল আরেক বিশাল কাজ। যাহোক পিরামিড ভাঙার কাজ বন্ধ হতে বাধ্য হয়েছে যখন হিসাব করে দেখা গেল, ভাঙতে যে খরচ ও পরিশ্রম হবে তার চেয়ে নতুন পিরামিড বানানোই অপেক্ষাকৃত সহজ।
 

অর্ধগোলাকার হুপ হাউস


সপ্তাশ্চার্য হোক আর যাই হোক বর্তমান পৃথিবীর মানুষ কিছুতেই মেলাতে পারে না, একজন মৃত ব্যক্তির জন্য দাসদাসী, ধন-দৌলত ও নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যাবহার সামগ্ররীর এত বিপুল আয়োজন করা কতটা যুক্তিসঙ্গত ছিল। ফেরাউনরা প্রচার করত, তারা ছিল জনগণের ‘লিভিং গড’। তাদের অদ্ভুত এক বিশ্বাস ছিল, মর্ত্য থেকে স্বর্গে যাওয়ার জন্য সমাধি হল একধরনের ‘ট্রানজিশন’, ক্রান্তিকালের আশ্রয়-শিবির, যেখানে অনির্দিষ্টকাল ধরে স্বচ্ছন্দে অবস্থানের জন্য তাদের জন্য নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর যোগান দেয়া হত। প্রায় ৭ বছর ধরে নির্মাণকাজের পর ১৯৩৯ সালে শেষ হয়েছে নিউইয়র্কের ‘রকেফেলার সেন্টার’ যা পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর বাণিজ্যকেন্দ্র। এর আয়তন মোটামুটিভাবে খুফুর পিরামিডের সমান। ৭০ তলা-বিশিষ্ট রকেফেলার সেন্টার তৈরি করতে ৬৬ বিঘা জমির প্রয়োজন হয়েছে যাকে বলা হয় ‘সিটি উইদিন এ সিটি’। এর ৮০ লক্ষ বর্গফুট অফিস-স্পেসে জনপ্রতি ৮০ বর্গফুট করে হিসাব করলেও এতে কাজ করতে পারে এক লক্ষ মানুষ। এই মনোরম কেন্দ্রে প্রতিদিন বেড়াতে যায় ৪ থেকে ৫ লক্ষ মানুষ যা সবসময় প্রাণবন্ত থাকে। অথচ পিরামিডে বাস করে মৃত এক প্রাচীন অত্যাচারী। রাজকোষ শূন্য করে, প্রজাদের কষ্টের বিনিময়ে তৈরি হয়েছে আমাদের প্রেমের তাজমহলও। অর্থ ও মূল্যবান ভূমির এমন অপচয় একজন যৌক্তিক বিবেকবান মানুষ কখনো মেনে নিতে পারে না। তবে আমরা এসব পিরামিডের জ্যামিতিক আকারকে বায়ুগতিনিরোধক ‘অ্যারোডাইনামিক গ্রীনহাউস’ বানানোর চেষ্টা করতে পারি। কার্যকর প্রমাণিত হলে গ্রীনহাউসের জগতে এটি একটি মডেল হবে যা ভবিষ্যৎ চাষাবাদে সহায়ক হতে পারে।
 

জিওডিসিক ডোম গ্রীনহাউস


খুফুর পিরামিডের কাঠামো ৪টি সমবাহু ত্রিভুজের সমষ্টি, যার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় সিকি কিলোমিটার (২৩০ মিটার) এবং উচ্চতা ১৪৭ মিটার। অর্থাৎ গ্রীনহাউসের জন্য সমানুপাতিক মাপ হতে পারে ১১ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন সমবাহু ত্রিভুজ যার বাহুগুলো ১৬ ফুট করে। এই অ্যারোডাইনামিক পিরামিডের উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য ১১:১৬ অনুপাতে হতেই হবে এমন নয়, রদবদল হতে পারে। ফেরাউন খ্যাফরেন তার নিজের পিরামিডের উচ্চতাও খুফুর পিরামিডের অনুপাত থেকে বেশি করেছে। তবে নির্মাণকাজ সহজ হবে যদি একই রকম ১৬ ফুট মাপের ঢালু বিম ব্যবহার করা হয়। এসব বিম তৈরি হতে পারে গজারির খুঁটি অথবা গ্যালভানাইজড্ আয়রন পাইপ দিয়ে। গ্যালভানাইজ করা পাইপ বহুবছর রং করতে হয় না, কারণ সহজে তাতে মরিচা ধরে না। এই বর্গাকার পিরামিড-গ্রীনহাউস ইউনিটকে বড় করা যায় সহজে। এক্ষেত্রে পিরামিডকে কোনাকুনি কেটে নিতে হবে দুইভাগে, তারপর মাঝখানে যোগ করতে হবে এক্সটেন্ডার ইউনিট (ছবি দ্রষ্টব্য)। কাঁচ দিয়ে ঢাকলে এর খরচ বেড়ে যাবে তাই পলিথিন দিয়ে মুড়ে নিলে খরচ কম হবে। তাপ, অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প, উদ্বায়ী গ্যাস ইত্যাদি নির্গমনের জন্য উপরে একটি ক্যানপি নির্মাণ করা যেতে পারে, নইলে ঢালু পাশ থেকে দরজা তৈরি করতে হবে। এই মডেল মাঠে ময়দানে পরীক্ষা করে দেখতে হবে ঠিক কিভাবে এটি স্বল্প খরচে কৃষির উপযোগী করে নির্মাণ করা যায়।

ইউরোপেই প্রথম গ্রীনহাউসগুলো বেশি তৈরি হয়েছে যা ছিল প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ। নেদারল্যান্ডের একটি এলাকায় এত বেশি গ্রীনহাউস তৈরি হয়েছে যে ঐ এলাকার নাম হয়েছে ‘গ্লাস সিটি’। এই গ্লাস সিটিতে নেদারল্যান্ডের ৫০ শতকের বেশি ফলমূল ও সবজি উৎপন্ন হয়। নিউইয়র্ক বোটানিক্যাল গার্ডেনে দুটি নামকরা গ্রীনহাউস আছে। একটি ‘হপ্ট কনজারভেটরি’ যা ব্রিটিশ ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে তৈরি হয়েছে ১৯০২ সালে এবং রিস্টোর করা হয়েছে ১৯৯৭ সালে। আমেরিকায় ভিক্টোরিয়ান ডিজাইনের গ্রীনহাউসগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। দ্বিতীয়টি হল ‘নোলেন গ্রীনহাউস’। ৪৩ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই গ্রীনহাউসে যাবতীয় সুবিধাসহ ফ্লোর পর্যন্ত গরম রাখার বন্দোবস্ত আছে। এতে মরু অঞ্চল, জলজ উদ্ভিদ, অর্কিড, ফার্ন ইত্যাদি গাছের ৮টি ভাগ আছে। ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ড, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, ভারতের বাঙ্গালোর, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে পরিদর্শন করার সুন্দর গ্রীনহাউস রয়েছে।
 

পোর্টেবল টাইপ বাবল্ হাউস


পৃথিবীর যাবতীয় গ্রীনহাউসের মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী একটি হল ‘এমান্ডসেন-স্কট সাউথপোল স্টেশন’। এটাকে বলা যায় স্টেশনের জন্য ‘ফুড প্রোডাকশন হাউস’। এই ছোট গ্রীনহাউসের দৈর্ঘ্য ২৮ ফুট ও প্রস্থ ১৮ ফুট হলেও প্রতি সপ্তাহে এখান থেকে ৩০-৪০ কিলো সবজি উৎপন্ন হয়। শীতকালীন দক্ষিণ মেরুতে সূর্য নেই বলে এর ভিতরে কৃত্রিম আলো ব্যবহার করা হয়, এমনকি কার্বন ডাই-অক্সাইডও। মাটির পরিবর্তে এখানে ব্যবহৃত হয় পুষ্টিজলসমৃদ্ধ হাড্রোপনিক সিস্টেম। অফিসের কর্মচারীরা মাঝে মাঝে এই গ্রীনহাউসের ভিতর চায়ের কাপ হাতে কৃত্রিম রোদ পোহাতে আসেন।

পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতির গ্রীনহাউস দেখা যায় পরিবেশ, সরঞ্জাম, নান্দনিকতা, অর্থায়ন,পর্যটন ইত্যাদি নানা কারণে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটির মধ্যে আছে ‘জিওডিসিক ডোম’ গ্রীনহাউস যা দেখতে ফুটবল-কাটা অর্ধগোলকের মত। এতে ব্যবহার করা হয় মিশ্রিত পঞ্চভুজ ও ষড়ভুজ প্যানেল যেমনটা দেখা যায় ফুটবলের সেলাইতে। মূলত পঞ্চভুজ ব্যবহারের কারণেই গোলাকার রূপ নিতে পারে ফুটবল। যেসব দেশে উন্নত প্রযুক্তি আছে তারা অল্প খরচে দ্রুত নির্মাণের জন্য অর্ধগোলাকার লোহার পাইপ ব্যবহার করে যা ‘হুপ হাউস’ নামে বেশি পরিচিত। ইদানীং এক ধরনের হাল্কা ফোল্ডিং টাইপ পোর্টেবল গ্রীনহাউসও পাওয়া যায়, যা গাছ জন্মানো ছাড়া বিনোদনের জন্যও ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীতে এমন দিন সমাসন্ন যখন গ্রীনহাউস ছাড়া ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মেটানো অসম্ভভ হয়ে পড়বে। যে দেশ যত দেরি করে সিদ্ধান্ত নেবে সেই দেশ লোকবল ও অর্থনীতিতে তত ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

লেখক: প্রকৌশলী এবং উদ্ভিদ বিষয়ক লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়