ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দারিদ্র্য গ্রামীণ নারী উন্নয়নে প্রধান বাধা

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৩, ৮ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দারিদ্র্য গ্রামীণ নারী উন্নয়নে প্রধান বাধা

খায়রুল বাশার আশিক: জীবনের প্রয়োজনে দিনভর খাটুনির পর সন্ধ্যারাতে নাতিকে কোলে নিয়ে ভূত-প্রেত-দানবের গল্প শোনানোর মুহূর্তটা বৃদ্ধা দাদী সাহিদা খানমের জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন। কুপির আলোর দিকে তাকিয়ে কল্পনার জাহাজে ভেসে নাতি-নাতনিরা ঘুমিয়ে যায় দাদীর কোলে। স্নেহের নাতিকে জরিয়ে ধরে রাত কাটে দাদীর। আবার খুব সকালেই আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে দাদীর, নামাজ পরেই শুরু করেন দিনের কর্মযজ্ঞ। ধান সিদ্ধ, রোদে সেই ধান শুকাতে দেয়া, বারবার ধানগুলো পা দিয়ে নেড়ে দেয়া, সঙ্গে পরিবারের জন্য রান্নার যোগান দেয়া- সব সামলাতে হয় বরগুনার বালিয়াতলী গ্রামের নারী সাহিদাকে।

এমন গল্প শুধু সাহিদার একার নয়। এমন হাজারো সাহিদা প্রতিনিয়ত অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন গ্রামের পরিবারগুলোতে। গ্রামীণ সমাজে অসংখ্য সাহিদা প্রতিদিন নিজের আঁচলে আগলে রাখেন সংসার। পাশাপাশি দেখভাল করেন সকল কাজের। শুধু ঘরের কাজ নয়, ঘরের বাইরে সব কাজেও গ্রামীণ নারীর পদচারণা প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছে গ্রামীণ সমাজকে। পুরুষের পাশাপাশি হাতে হাত মিলিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে নারীর পদচারণা এখন সুস্পষ্ট। গ্রামে নারীদের কাজের পরিধিও বেড়েছে। যেকোনো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে কাজ করছেন। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে পুরুষের সমান তালে। আইন বিষয়ে অজ্ঞতা, অধিকার অসচেতনতা, গতানুগতিক ভাবধারা, বংশগত ঐতিহ্য, কুসংস্কার, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, ফতোয়া, পর্দাপ্রথার মতো সমাজকেন্দ্রিক বিষয়গুলো পায়ে ঠেলে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের নারী।



পাশাপাশি নারীর অধিকার সম্পর্কেও এখন সচেতন তারা। জমিজমা ভাগ বণ্টনসহ বিভিন্ন অংশীদারিতে গ্রামেও নারীদের অবস্থান বর্তমানে সুদৃঢ়। দেশ ও সামাজিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় গ্রামে নারী শিক্ষার হার বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে গ্রামের নারীরা আগের চেয়ে সচেতন। এত সম্ভাবনার মাঝেও গ্রামকেন্দ্রিক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীর পথচলাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করে। উপকূলীয় জেলা বরগুনা, পটুয়াখালি, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও ভোলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামীণ পরিবেশ, অবকাঠামোগত অপর্যাপ্ততা, প্রযুক্তির দুর্লভ প্রাপ্যতা, দারিদ্র্য, দুর্যোগ ঝুঁকি, যৌতুক প্রথাসহ নানান সামাজিক সমস্যা নারীর জীবনমান উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বল্পতা, দূরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা উপকরণের স্বল্পতা গ্রামের নারী শিক্ষার অন্যতম অন্তরায়। শুধুমাত্র নিকটস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবেই নারীশিক্ষা থমকে যাচ্ছে। মাধ্যমিকের গণ্ডি কোনোমতে পার হলেও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পরছে উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার ছাত্রী।

উপকূলের নারী উন্নয়নের আরো একটি বাধা বাল্যবিবাহ। মেয়ের বয়স ১৪-১৫ হলেই শুরু হয় পাত্র দেখা, তারপর বিয়ের আয়োজন। অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। এছাড়াও কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে পুরুষের বেকারত্ব নারীর জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামে পুরুষের বেকারত্বের ফলেই এখনো পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না যৌতুক প্রথা। বরগুনা সুযারখেয়াঘাট আশ্রয়ন প্রকল্পের নারী বাসিন্দা রীনা বেগম বলেন, আমরা এখন পুরুষের মতোই কাজ করি। আমি আমার স্বামীর মতোই পরিবারের প্রয়োজনে বিভিন্ন কাজ করি। আশপাশের আনেক মহিলা যে যার মতো রোজগারের চেষ্টা করে। গ্রামে নারীর কাজের মূল্য কম। তবুও নারীরা থেমে থাকে না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীর জন্য কর্মবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলেই কমে আসবে নারী পুরুষ অসমতা।



বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মোর্শেদা নাজনিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী উন্নয়ন নিশ্চিত হচ্ছে। নারীর অধিকার সম্পর্কে নারীদের সচেতন করার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্ষণশীল মনোভাব পরিবর্তন করতে পারলে সমাজ থেকে কমে আসবে নারী নির্যাতন।’

তিনি আরো জানান, দারিদ্র্য নারী উন্নয়নের প্রধান বাধা। দারিদ্র্য দূরীকরণের এজেন্ডা প্রধান হিসেবে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেয়া হলে সহজ হবে নারীর উন্নয়ন। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ রোধ, শিক্ষা ব্যবস্থা সহজলভ্য করা, দুর্যোগ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে নারীকে রক্ষা করা গেলে আরো বিকশিত হবে নারী উন্নয়নের পথ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়