ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

উপকূলের পথে

উড়িরচরে শান্তি ফিরুক

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ১৭ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উড়িরচরে শান্তি ফিরুক

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সন্দ্বীপের উড়িরচর ঘুরে : বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উড়িরচরে স্থায়ীভাবে শান্তি ফিরুক- এমন আশাবাদ বাসিন্দাদের। তারা চান, মানুষ যেন নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারেন; ব্যস্ত থাকতে পারেন স্বাভাবিক জীবনের কাজকর্মে। যেন ঘরে তুলতে পারেন ক্ষেতের ফসল; পণ্য বিক্রি করতে পারেন হাটে-বাজারে। ১৬ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত দস্যু নেতা ইব্রাহিম মাঝির মৃত্যুর পর দ্বীপবাসীর এই আশাবাদ আরো প্রবল হয়েছে। দস্যু নেতার মৃত্যুতে স্বস্তি ফিরেছে ঘরে ঘরে।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেল, চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের দ্বীপ ইউনিয়ন উড়িরচরে এখনও ভয় কাটেনি। দফায় দফায় দস্যু দমন অভিযানে একের পর এক শীর্ষ দস্যুদের প্রাণহানি ঘটলেও তাদের দোসসরা সক্রিয়। আগে প্রকাশ্যে জমির ফসল, বাড়িঘর এমনকি খাস জমি লুট হলেও এখন সেই তৎপরতা অব্যাহত আছে। দুষ্কৃতিকারীরা আড়ালে চালাচ্ছেন সেই তৎপরতা। ফলে এলাকার সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানির শিকার।

বাসিন্দারা বলছেন, উড়িরচরের মানুষের সংকট পিছু ছাড়ে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও এখানে গত কয়েক বছর দস্যু শাসনে মানুষ অতিষ্ঠ। ২০১৪ সালে যৌথ অভিযানে দস্যু শাসনের অবসান ঘটলেও নীরব আতঙ্ক বিরাজ করছে এখনও। প্রকাশ্যে দস্যুদের শাসন না থাকলেও খাসজমিতে ভূমিহীনদের বসতি স্থাপন, জমির দখলসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দস্যু বাহিনীর লোকজনের হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের সঙ্গে উড়িরচরের সীমানা বিরোধ থাকায় দস্যুদের অপতৎপরতা পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না।

সরেজমিনে উড়িরচরের জনতা বাজার, হাজারী বাজার, মিয়ার বাজার, বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাসিন্দাদের কাছ থেকে নানামূখী অভিযোগ পাওয়া গেছে। দফায় দফায় অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নিহত হলেও তাদের দোসররা এখনও সক্রিয় বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। এই অভিযোগের সঙ্গে একমত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। উড়িরচরের যেখানেই মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, সব কথা শেষে আড়ালে আবডালে তাদের দাবি একটাই- দ্বীপে শান্তি ফেরাতে সন্ত্রাসীদের পুরোপুরি নির্মূল করতে হবে।   

সাহেব মিয়া বাজারে আলাপ হচ্ছিল বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী বলছিলেন, ‘আমি জমি লইছি সন্ত্রাসের আমলে। এহন আমাগো এহানে থাকতে দ্যায় না। হিয়ার ঘর দুয়ার ছোল্ইায়া হালায়। হেইয়ার কেস দিছে, মামলা দিছে। কোর্ট সারেন্ডার করে আমরা হাজিরা দিই। তারপরও আমরা ঘরে থাকতাম হারি না। ঘর দুয়ার কোপাইয়া ম্যালা অত্যাচার করছে। আমরা আর হারি না। আমরা এহন কিত্তাম? আমাগো কি মাইয়া হালাইবেন, না কাইডা হালাইবেন, আন্নারাই করেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুরুষ ভূমিহীন বলেন, ‘আমরা এখানে বসতি করে খুবই অসহায় অবস্থায় আছি। আমাদের এখানে রাস্তাঘাট নাই, স্কুল নাই। আমাদের এখানে কোন সরকারি অনুদান আসে না। আমরা সাধারণ ভূমিহীন হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চলে। টাকা দিয়ে জমি নিলেও সে জমিতে আমরা থাকতে পারছি না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন ভূমিহীন বলেন, ‘আমরা নদীভাঙ্গা মানুষ। উড়িরচরে আইছি একটু মাথা গোঁজার জন্য। শান্তিতে বসবাসের জন্য। কিন্তু বিভিন্ন লোকজন আমাদের ওপর অত্যাচার করে। আমরা একটু শান্তি চাই।’ একইভাবে আরেকজন ভূমিহীন বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমি এখানে ঘর তুলেছিলাম। রাত্রে সন্ত্রাসীরা এসে আমার ঘর কুপিয়ে তছনছ করে। ঘরের টিন কোপায়। একটা ছাগলও মেরে ফেলে। এখনও আমরা আতংকে বসবাস করছি। তারা আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।’
 


স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, সন্দ্বীপের শান্তির এই দ্বীপটি সন্ত্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে থাকে ২০০২ সালের দিকে। ২০০৩-২০০৪ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর সন্ত্রাসীরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেয়। দ্বীপে হারিস চৌধুরী নামের এক লোক সারের ব্যবসার নাম করে উড়িরচরে আসেন। প্রথমে তিনি ব্যবসার জন্য জমি চান স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে। চোরাচালান সন্দেহ হওয়ায় চেয়ারম্যান জমি দিতে রাজি হননি। চরের বয়সী ব্যক্তিরা বলেন, বেশ আগে থেকেই এখানে খাসজমির বন্দোবস্ত নিয়ে দু’টি গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। ওই দুই গ্রুপের এক গ্রুপের পক্ষে অবস্থান নেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খায়রুল আনাম মিয়া। অপর গ্রুপের পক্ষে অবস্থান নেন ইউপি চেয়ারম্যানের ওপর ক্ষুব্ধ হারিস চৌধুরী। ২০০৭ সালে এই দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘাত হলে হারিস চৌধুরী মারা যান। এরই জের ধরে মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে আরেক সংঘর্ষে ইউপি চেয়ারম্যানসহ তিনজনকে জবাই করে আগুনে পুড়ে ফেলা হয়।

এরই জের ধরে ২০১০ সালে হারিস চৌধুরীর পক্ষের লোক হিসেবে ইব্রাহিম মাঝি (১৬ মার্চ যার প্রাণহানি ঘটেছে) হাতিয়ার তৎকালীন জাহাইজ্জার চরের নিয়ন্ত্রণকারী নিজাম ডাকাতকে ভাড়া করে উড়িরচরে আনে। উদ্দেশ্য ছিল খাসজমি বিক্রির বাণিজ্য করে ভূমিহীনদের খাসজমিতে বসানো। এক পর্যায়ে এই বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে ভাড়ায় আসা নিজাম ডাকাতের কাছে। ইতিমধ্যে উড়িরচরে তার দেড় শতাধিক সাঙ্গপাঙ্গ তৈরি হয়ে যায়। এদের মাধ্যমে খাসজমি বাণিজ্যে নিজাম ডাকাত অন্তত কোটি টাকা এবং ৫০ জোড়া মহিষ নিয়ে নেয়।

অবশেষে নিজাম ডাকাতকে হটাতে নিরুপায় ইব্রাহিম মাঝি ২০১২ সালের দিকে আরেক সন্ত্রাসী শাহাদাৎ হোসেন জাসু’র সঙ্গে হাত মিলায়। মোটামুটি বছরখানের উড়িরচরে এদের যৌথ নেতৃত্ব চলে। জাসু ধরা পড়ে জেলখানায় আটক থাকাকালে নিজাম ডাকাতের লোকজন অন্তত তিনবার চর আক্রমণ করে। জাসু ছাড়া পেলে আবারও যৌথভাবে অপতৎপরতা অব্যাহত রাখে দুই দস্যু নেতা ইব্রাহিম ও জাসু। এক পর্যায়ে এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, দানা বাঁধে অবিশ্বাস। এরই জের ধরে ২০১৩ সালে ইব্রাহিমকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করে জাসু। এর মধ্য দিয়ে উড়িরচরে জাসু বাহিনীর একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। তৈরি হয় তার পক্ষের অনেক লোকজন।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, উড়িরচরে সবচেয়ে সংকটাকাল ছিল ২০১৩ সাল থেকে। দস্যু নেতা জাসু বাহিনীর অত্যাচারে সমগ্র উড়িরচর ছিল স্তব্ধ। অস্ত্রের মুখে কারও মুখ খোলার সাহস ছিল না। খাসজমি বিক্রি, জমির ধান লুট, বাড়িঘর-হাটবাজার লুট, নারী ধর্ষণসহ বহুমূখী অপরাধে লিপ্ত ছিল জাসু বাহিনীর সদস্যরা। এই রাজত্ব যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই ২০১৪ সালে জাসু বাহিনীর প্রধান জাসুসহ ১১ জন একদিনে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে মারা যায়। ভয়ের জনপদে হঠাৎ করেই ফিরে আসে শান্তি। কিন্তু জাসু বাহিনীর অধ্যায় শেষ হলেও ইব্রাহিম মাঝির তৎপরতা এতদিন ধরে নীরবে চলেছে। ইব্রাহিম মাঝির অধ্যায়ও শেষ হলো।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বাহিনীর অনেক সদস্য প্রাণ হারালেও তাদের দোসররা ঘাপটি মেরে আছে। নীরবেই  তারা বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এখনও প্রকাশ্যে স্থানীয় বাসিন্দারা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ ও সন্দ্বীপের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যৌথ অভিযানের মাধ্যমে উড়িচরের সন্ত্রাসীদের দমন করা হয়েছে। সেখানকার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। এদিকে উড়িরচরের ভারপ্রাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বলেন, এক সময় এখানে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন করাই কঠিন ছিল। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় দস্যু দমন হয়েছে। এখন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। কিন্তু এখনও কোন কোন এলাকায় মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। আশা করছি অচিরেই এখানে পুরোপুরি শান্তি ফিরে আসবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়