ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

উপকূলের পথে

উপকূলে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২২ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপকূলে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে

রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে : প্রকৃতির এ কেমন নিষ্ঠুর রসিকতা! পানির মধ্যেই বসবাস অথচ ‘পানি দুর্ভিক্ষের’ শিকার উপকূলবাসী। তৃষ্ণা মেটানোর পানির বড়ই অভাব তাদের। এক ফোঁটা বিশুদ্ধ পানি মহামূল্যবান তাদের কাছে।

উপকূলে বিশুদ্ধ পানির সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। চারিদিকে পানি থাকার পরেও এক ফোঁটা বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না মানুষ। একদিকে বাড়ছে লবণাক্ততা, অন্যদিকে পানির স্তুর নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি দূষণের মাত্রা যেমন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে, তেমনি পানি সরবরাহে রয়েছে অব্যবস্থাপনা। পানি সরবরাহে অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক স্থানে বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছাচ্ছে না বহু মানুষের কাছে। এর পাশাপাশি প্রভাবশালীদের খাময়েখালীপনায় পানির আধার সার্বজনীন হতে পারছে না।

পশ্চিম উপকূলে ঠিক পাঁচ বছর আগে যেমন পানির কষ্ট ছিল, এখনো তেমনই আছে। সংকট উত্তরণে উদ্যোগের শেষ নেই। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। তবে পানির কষ্ট খুব একটা লাঘব হয়েছে বলে মনে হয়নি। গ্রামের মানুষেরা এই সংকটকে ‘পানির দুর্ভিক্ষ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই কষ্ট থেকে বাঁচার আকুতি তাদের।

সরেজমিনে ঘুরে পশ্চিম উপকূলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা আর বাগেরহাটের শরণখোলার প্রত্যন্ত গ্রামে পানির কষ্টের বিপন্ন রূপ চোখে পড়ে। কষ্ট নিরাবণে মানুষগুলোর দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটা। সকাল-বিকেল-দুপুর জলের আধারগুলো ঘিরে নারী-পুরুষ ও শিশুদের জটলা। কলসি, বালতি, ড্রাম, জগ, যার যা আছে, তা নিয়েই ছুটে যায় পানির কাছে।

 


সুপেয় পানির সংকটটাই সবচেয়ে বেশি। কোথাও আবার গোসল, রান্নাবান্না আর সেচের পানির কষ্টও তীব্র হয়ে ওঠে। অর্থের বিনিময়ে মানুষকে পানি কিনতে হয়। অতিথি আপ্যায়নে পেটভরে খাবার দেওয়া সম্ভব হলেও এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি দেওয়াটা যেন এসব এলাকার মানুষের কাছে অনেক কষ্টের।

সূত্র বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন এই এলাকায় লবণাক্ততা বাড়িয়েছে। ২০০৯ সালের মে মাসে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার আগে এই এলাকায় এতটা পানির সংকট ছিল না। কিন্তু আইলার প্রলয় সব পানির আধার লবণ পানিতে ডুবে যায়। বিভিন্ন উপায়ে যেসব আধার থেকে সুপেয় মিঠা পানি সংগ্রহ করতেন, সেসব আধারে এখন লবণ পানি। আইলার পর থেকে ডোবা-নালা থেকে লবণ সরানো যাচ্ছে না। এর ওপর চিংড়ি চাষের আগ্রাসন তো আছেই। অধিক লাভের আশায় বহু মানুষ ফসলি মাঠে লবণজল ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করছে। চিংড়ি ঘেরের লবণ পানি ঢুকে পড়ছে মিঠা পানির পুকুরে। এভাবে মিঠা পানির সংকট দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ঠিক সুপেয় পানির সঙ্গে বোরো আবাদের জন্য সেচের পানির সংকটও এসব এলাকায় প্রকট।  

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আটুলিয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া আর আটুলিয়া। এখানে প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস। কম করে হলেও লোকসংখ্যা দেড় হাজারের ওপরে। এই গ্রাম থেকে সুপেয় পানির উৎস কমপক্ষে তিন কিলোমিটার দূরে। এই দুই গ্রামের মানুষ পানি সংগ্রহ করেন একই ইউনিয়নের হেঞ্চি গ্রামের মনোরঞ্জন বৈরাগির বাড়ির পুকুর পাড়ে বসানো ফিলটার থেকে। দিনের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয় ভোর থেকে। কার আগে কে যাবে। লাইনে আগে থাকার চেষ্টা সবার। আগে ভাগে পানি ঘরে তুলতে পারলে অন্যান্য কাজে সময় দেওয়া সম্ভব হবে।

পানির কষ্টে থাকা একজন বাসিন্দা তাপস কুমার মণ্ডল। বাড়ি আটুলিয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া গ্রামে। পেশায় স্কুল শিক্ষক। তিনি জানান, যবে থেকে আইলার প্রলয়ে সব শেষ হলো, তখন থেকেই পানির কষ্ট। বেঁচে থাকার জন্য সুপেয় পানির বিকল্প নেই। কিন্তু এই দুই গ্রামের কোনো মানুষই প্রয়োজনীয় সুপেয় পানি পায় না। ভোর হলেই পানির সন্ধানে ছুটতে হয়। সকাল ও বিকেলে পানির ফিল্টারের কাছে সংগ্রহকারীদের লাইন দীর্ঘ হয়। পানির সংকট ১২ মাসই থাকে। তবে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে তীব্রতা একটু বেশি।

খানিক এগিয়ে একই গ্রামের সুজাতা মণ্ডলের বাড়ি গিয়েও একই চিত্র। দিনে যে দু’কলসি পানি প্রয়োজন হয়, তা সংগ্রহ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তিনি বলেন, ‘পানির কষ্টে আমরা তো মরি গেলাম।’
 


সুপেয় পানি সংকটের চিত্র চোখে পড়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরায়। ইউনিয়নের হাজারো মানুষ বছরের পর বছরের পানির কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। এই ইউনিয়নের লক্ষীখালী গ্রামের জরিনা খাতুন এক কলসি সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে দৈনিক ১০ কিলোমিটার পথ হাঁটেন। যেতে আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এক কলসি পানিতে দিন পার হয় না বলে একই সঙ্গে পানি সংগ্রহে ছুটেন ঘরের আরো দু-তিন জন।

ইউনিয়নের ১০ নম্বর সোরা গ্রামের মো. ইদ্রিস মোড়লের স্ত্রী আছমা খাতুনের ঘরে ঢুকেই বোঝা যায় পানির সমস্যা তাদের কতটা সংকটে রেখেছে।

ঘরের ভেতরে কলসি, ড্রাম, থালাবাটি এমনকি পলিথিনে করেও পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এদের ঘরে এক ফোঁটা পানির মূল্য অনেক। নারী-পুরুষ ও শিশুরা পায়ে হেঁটে পানি আনেন, আবার কখনো ড্রাম ভরে ভ্যানে করেও আনেন। এতে পানির মূল্যটা আরো বেড়ে যায়।

এলাকা ঘুরে জানা যায়, ঘরে একবেলা খাবার যোগাড়ের চেয়েও এই এলাকার মানুষের সুপেয় পানি যোগাড়ে বেশি সমস্যা। চাল, ডাল, নুন, তেল সবাই যোগাড় হলো; কিন্তু ঘরে সুপেয় পানি নেই। এর মানে সব কিছুই অচল।

পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিভিন্ন দ্বীপ-চর ঘুরে সুপেয় পানি সংকটের ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়ে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে বহু মানুষের বসবাস থাকলেও সেখানেই প্রয়োজনীয় গভীর নলকূপ। বিচ্ছিন্ন এলাকার বহু মানুষ সারা বছরই সুপেয় পানির সংকটে থাকেন। আবার কোথাও নলকূপ বসালেও নদী ভাঙনের কারণে বহু নলকূপ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার রেশ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি উপকূলীয় জেলার ৬৪টি উপজেলার প্রায় ৪০ লাখ দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বয়ে চলেছে। আইলার পর বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও ভূ-প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট কারণ ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবে এ অঞ্চলে পানি ও স্যানিটেশন সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। এ অঞ্চলের মাটিতে বর্তমানে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬ থেকে ১৫ দশমিক ৯ পিপিটি। অথচ মাটির সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ৪ থেকে ১ দশমিক ৮ পিপিটি। লবণাক্ততার কারণে গাছপালার পরিমাণও আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। পুকুরে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মাছসহ সব জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে।
 


বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাইনর ইরিগেশন ইনফরমেশন সার্ভিস ইউনিট পরিচালিত ‘দক্ষিণাঞ্চলের ভূগর্ভে লবণ পানির অনুপ্রবেশ পূর্বাভাস প্রদান’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানিতে বঙ্গোপসাগর থেকে লবণ পানি এসে মিশছে। এপ্রিল-মে মাসে সাগর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে গোপালগঞ্জ ও নড়াইলের লোহাগড়ায় মধুমতী নদীতে লবণ পানি পাওয়া গেছে।

বরিশাল মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, সাগরের কাছের নদীগুলোর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা আগের থেকে অনেক বেড়েছে এবং বেশি সময় দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। বছর দশেক আগেও এই অঞ্চলের নদীগুলোয় লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ত এপ্রিল থেকে মে-জুনে। এখন কপোতাক্ষ, শিবসা, পশুর, ভৈরব, রূপসা, বলেশ্বর, কচা, পায়রা, বিষখালী প্রভৃতি নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারি থেকে।

ওই গবেষণা সূত্রের দাবি, মাটিতেও বেড়েছে লবণাক্ততার পরিমাণ। সূত্র বলছে, বরিশাল বিভাগের ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৩০ হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমি অতি লবণাক্ততার কবলে রয়েছে। এসব জমিতে লবণের পরিমাণ সময় বিশেষে ১৬ থেকে ২৮ দশমিক ৫ ডেসিসিমেন (প্রতি মিটার পানিতে লবণের পরিমাণ)। বরিশাল বিভাগের লবণাক্ততায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ জেলা বরগুনা। এ ছাড়া পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও বরিশাল জেলার নদীগুলোয় মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা বাড়ছে প্রতি বছর।

উপকূলের পানি সংকট নিরসনে স্থানীয় বাস্তবতাকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেছেন, নিরাপদ পানি, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে এলাকা-উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বৃহৎ গবেষণা উদ্যোগ নিতে হবে। তারা বলেন, ভেঙে যাওয়া বাঁধ উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে, স্লুইজ গেট স্থাপন ও টেকসইভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, পুকুরসহ সুপেয় পানির উৎসগুলো পুনঃখননের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। বৃষ্টির পানির যথাযথ সংরক্ষণের ওপরও জোর দেন বিশেষজ্ঞরা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মার্চ ২০১৮/রফিকুল ইসলাম মন্টু/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়